চাকরিপ্রার্থীদের জন্য সিভি লেখার নিয়ম জানা অতি জরুরি একটি বিষয়। কারণ চাকরি খোঁজার সময় প্রথমেই আমাদের যে কাজটি করতে হয়, তা হলো সঠিক উপায়ে মানসম্মত একটি সিভি তৈরি করা। সিভির মাধ্যমেই একজন চাকরীপ্রার্থী চাকরীদাতার মনে জায়গা করে নিতে পারেন। তাই সিভির গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
আপনি সিভিতে নিজেকে যতবেশি সুন্দরভাবে উপস্থাপন করবেন, চাকরিদাতাও আপনার প্রতি ততটা আগ্রহী হয়ে উঠবেন। সব সময় এটা মনে রাখা উচিৎ, সিভিই হচ্ছে চাকরীদাতা এবং আপনার মধ্যে পরিচয়ের প্রথম মাধ্যম। তাই এমন একটি সিভি তৈরি করা প্রয়োজন, যাতে চাকরীদাতা সিভি দেখেই আপনার প্রতি ইতিবাচক ধারণা পোষণ করেন।
প্রফেশনাল সিভি লেখার নিয়ম
সিভির প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে চাকরীদাতার কাছে নিজের তথ্যগুলোর এক ঝলক তুলে ধরা। বর্তমানে আধুনিক সিভিতে শুধু শিক্ষাগত যোগ্যতা, দক্ষতা বা অভিজ্ঞতাই নয়, এর থেকেও বেশি কিছু থাকে। আজকের এই আর্টিকেলে আমরা প্রফেশনাল এটি সিভি লেখার নিয়ম জানবো, যেখানে মানসম্মত একটি সিভির সকল বৈশিষ্ট্য থাকবে।
শুধু তাই নয়, আর্টিকেল শেষে আমরা কিছু নমুনা (Sample) সিভি যুক্ত করে দেব। যা দেখে আপনি নিজের জন্য একটি প্রফেশনাল মানের সিভি তৈরি করতে পারবেন। পাশাপাশি নিজের প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে সিভিটি তৈরি করে প্রিন্ট করে নিতে পারবেন।
সেকশনগুলোর যথাযথ স্তরবিন্যাস
১. যোগাযোগের তথ্যসহ শিরোনাম (Heading): বর্তমানে মডার্ন সিভিগুলোতে শিরোনামের (Heading) সাথে যোগাযোগের সংক্ষিপ্ত তথ্যও সংযুক্ত থাকে। এর ফলে সিভি দেখার শুরুতেই আপনার সাথে যোগাযোগের তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়। তাই শিরোনাম আপনার নাম, তার সাথে ইমেইল এবং ফোন নম্বর সংযুক্ত করুন।
২. ছবি: যেহেতু আপনি একটি চাকরি পাওয়ার আবেদন করতে যাচ্ছেন, আপনার সিভিতে ব্যবহার করা আপনার ছবিটি প্রফেশনাল হওয়া উচিত। পোশাক ফরমাল রাখুন এবং ছবিটি সম্পূর্ণ ন্যাচারাল রাখুন। অতিরিক্ত এডিট করে নিজের চেহারাটাই বদলে দেবেন না যেন।
[penci_related_posts dis_pview=”no” dis_pdate=”no” title=”এই বিভাগ থেকে আরো পড়ুন” background=”” border=”” thumbright=”no” number=”4″ style=”list” align=”none” withids=”” displayby=”cat” orderby=”rand”]পাশপাশি ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড কালার হবে খুব সাধারণ। চাইলে ব্যাকগ্রাউন্ডে একেবারে সাদা বা হালকা নীল রঙ ব্যবহার করতে পারেন। তবে ব্যাকগ্রাউন্ডে যে রঙই ব্যবহার করুন না কেন, তা যেন আপনার পোশাকের সাথে মিলে যায়।
এমন একটি ছবি ব্যবহার করুন যা আপনি সম্প্রতি তুলেছেন। অনেক পুরোনো ছবি অবশ্যই ব্যবহার করা উচিত না। ছবি এবং সিভি আলাদা হলে এটি এডজাস্ট করার জন্য পেপার ক্লিপ ব্যবহার করতে পারেন। খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া স্টাপলার পিন ব্যবহার করবেন না।
৩. ব্যক্তিগত প্রোফাইল (Profile): আপনার ক্যারিয়ারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কি, এ সম্পর্কে সংক্ষেপে ৫ থেকে ৬ লাইন লিখবেন। ইচ্ছে করলে আপনার সিভির একটি সারাংশও এখানে তুলে ধরা যেতে পারে।
৪. অভিজ্ঞতা বর্ণনা (Experience): অনেকেই সিভিতে কাজের পূর্ব অভিজ্ঞতা শেষের দিকে উপস্থাপন করেন। কিন্তু মডার্ন সিভিগুলোতে শুরুর দিকেই কাজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়। অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ হলে খুব সহজেই চাকরিদাতার মনযোগ আকর্ষণ করা যায়।
তাই ধারাবাহিকভাবে আপনার কাজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করুন। প্রথমে পদের নাম, প্রতিষ্ঠানের নাম, কি দায়িত্ব পালন করেছেন সেই তথ্য এবং কত সময় ধরে দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত ছিলেন, তা উল্লেখ করুন।
৫. শিক্ষাগত যোগ্যতা (Educational Qualification): এটি সিভিতে মূল আকর্ষণের মূল অংশ হচ্ছে শিক্ষাগত যোগ্যতা সেকশন। এই অংশে সতর্কতার সাথে আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতা বর্ণনা করুন। শিক্ষা জীবনের সবশেষ পর্যায় থেকে শুরু করু পেছনের দিক বর্ণনা করুন। অর্থাৎ আপনি যদি মাস্টার্স সম্পন্ন করে থাকেন, তাহলে যথাক্রমে মাস্টার্স, অনার্স, এইচএসসি এবং এসএসসি পরীক্ষার তথ্য উল্লেখ করুন।
সম্ভব হলে টেবিল (ছক) বা চার্ট তৈরির মাধ্যমে শিক্ষাগত যোগ্যতা উল্লেখ করতে পারেন। টেবিল তৈরির ক্ষেত্রে পরীক্ষার নাম, বোর্ড, পাশের বছর, বিভাগ এবং ফলাফল এই ক্রম বজায় রাখতে পারেন। তবে মডার্ন সিভিগুলোতে এগুলোর পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামও উল্লেখ করতে দেখা যায়।
৬. দক্ষতা (Skill): এখনকার চাকরিগুলোতে শুধুমাত্র শিক্ষিত লোকদেরই চাওয়া হয় না, বিশেষ কাজে দক্ষতা আছে এমন প্রার্থীদেরও আহ্বান করা হয়। তাই আপনি যদি কোন কাজে দক্ষ হয়ে থাকেন, বিশেষ করে কারিগরি কোন দক্ষতা আপনার থেকে থাকে, তাহলে তা সাবলীল ভাবে এই অংশে বর্ণনা করুন।
এ অংশে সাধারণত কম্পিউটারের বেসিক ও অ্যাডভান্স স্কিল, ডাইভিং অথবা অন্য কোন দক্ষতার কথা উল্লেখ থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কম্পিউটারে বেসিক স্কিল না থাকলে আপনার সিভিটি গ্রহণযোগ্যতা হারাবে। তাই খুব ভালো হয়, যদি আপনি কোথাও সিভি সাবমিটের পূর্বেই গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয়ের ওপর দক্ষতা অর্জন করেন।
৭. অতিরিক্ত তথ্য ( Additional Section): অনেকেই সিভিতে Additional Section জুড়ে দিতে ভুল করেন। কিন্তু আপনাকে বুঝতে হবে সিভির গুরুত্বপূর্ণ এই অংশ আপনার সম্পর্কে অতিরিক্ত তথ্য তুলে ধরে। তাই এই অংশে আপনার অতিরিক্ত অর্জনগুলো উল্লেখ করতে পারেন। যেমন: পদক বা সম্মাননা, ভাষাগত দক্ষতা, সামাজিক ও সেচ্ছাসেবামূলক কর্মকাণ্ড ইত্যাদি।
অর্থাৎ চিরাচরিত প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালোর বাইরেও আপনার গুণাবলিগুলো এখানে তুলে ধরুন। এর ফলে আপনার ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে তাদের মধ্যে ধারণা জন্মাবে। যা আপনাকে প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করবে।
৮. রেফারেন্স (Reference): সিভিতে রেফারেন্স অংশটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। আপনার দেয়া তথ্যগুলো দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি থেকে যাচাই করার প্রয়োজনবোধের জন্যই সিভিতে রেফারেন্স চাওয়া হয়। তাই এমন কোন ব্যক্তি যিনি আপনাকে ভালো করে জানেন, তার নাম রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন।
হতে পারে তিনি আপনার কলেজের অধ্যক্ষ, কাউন্সিলর বা চেয়ারম্যান অথবা অন্য কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তবে রেফারেন্স হিসেবে যার নাম আপনি সিভিতে ব্যবহার করছেন, ব্যবহারের পূর্বে অবশ্যই তার থেকে অনুমতি নিয়ে নেবেন।
সিভির সঠিক ফরমেটিং
ফন্ট নির্বাচন: আমরা জানি সিভি লেখার নিয়ম হচ্ছে সুন্দর, মার্জিত এবং সহজবোধ্য ফন্ট (Font – অক্ষর) ব্যবহার করা। সাধারণ লেখার জন্য স্ট্যান্ডার্ড কিছু ফন্ট আছে। Times New Roman, Calibri, Arial, Tahoma, এবং Helvetica ফন্টগুলো যার মধ্যে অন্যতম।
তাই সিভি লেখার ক্ষেত্রে এই স্ট্যান্ডার্ড ফন্টগুলো ব্যবহার করুন। সঠিক ফন্ট নির্বচনের পাশাপাশি কত সাইজের ফন্ট ব্যবহার তা নির্ধারণ করাও জরুরি। সেকশনগুলোর শিরোনামের জন্য 14 থেকে 16 pt এবং ভেতরের বিস্তারিত লেখার জন্য 11 থেকে 12 pt ফন্ট ব্যবহার উত্তম।
লে-আউট ঠিক রাখুন: সিভির কাগজটি A4 মাপের রাখুন এবং লেখার সময় উভয় দিক থেকে কমপক্ষে ১ ইঞ্চি পরিমাণ জায়গা ফাঁকা রাখুন। সেকশনের শিরোনামগুলো Bold এবং Underlined করে দিতে পারেন।
অতিরিক্ত গ্রাফিক পরিহার করুন: সিভিটি অসাধারণ করতে গিয়ে মাত্রাতিরিক্ত গ্রাফিক এলিমেন্টের ব্যবহার করবেন না। এতে আপনার সিভি দেখতে দৃষ্টিকটু লাগবে এবং গ্রহণযোগ্যতা হারাবে। সিভিতে শুধুমাত্র আপনার ছবি ব্যতিত অন্যান্য বিষয়গুলো কালো রঙে প্রিন্ট করুন। পাশপাশি যে কাগজটিতে প্রিন্ট করবেন সেটি যেন ভাল মানের সাদা বা অফ-হোয়াইট কাগজ হয় সেইদিকেও লক্ষ্য রাখবেন।
বানান ও ব্যাকরণ: সিভি বাংলায় লিখুন বা ইংরেজীতে, তা মুখ্য বিষয় না। আপনি যে ভাষাতেই লিখুন না কেন, সিভির ভাষা অবশ্যই নির্ভুল হতে হবে। শুধু বানানই নয়, লেখা শেষে ব্যকরণগত ত্রুটিও যাচাই করতে হবে। মনে রাখুন, ছোট একটু ভুলের জন্যও আপনার সম্পর্কে চাকরীদাতার নেতিবাচক ধারণা তৈরি পারে। এর ফলে চাকরিটা আপনার হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে।
চাকরির ধরন অনুযায়ি সিভি: সব ধরনের চাকরিতে একরকমের সিভি প্রযোজ্য হয় না। শিক্ষক চেয়ে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে আপনি যেভাবে সিভি লিখবেন, বিজনেস ম্যানেজার পদের জন্য নিশ্চই সেভাবে লিখবেন না। তাই প্রতিটি চাকরির জন্য সিভিতে আলাদা প্রয়োজনীয় তথ্য যুক্ত করা সবচেয়ে ভালো। তার মানে চাকরীর চাহিদা অনুযায়ি আপনাকে সিভি তৈরি করতে হবে।
সিভিটি সংক্ষিপ্ত রাখুন: নব্বইয়ের দশকে আটকে থাকা সেই প্রার্থীদের একজন হবেন না, যারা মনে করেন যে তাদের জীবন সম্পর্কে প্রতিটি বিবরণ তাদের সিভিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এখন সময়ের পরিবর্তন হয়েছে। ফলে খুব অল্প কথাতেই নিজের সম্পর্কে অনেক কিছু বোঝানো উপায় রয়েছে।
আপনি যদি একজন ফ্রেশার বা সদ্য পাস করা চাকুরীপ্রার্থী হয়ে থাকেন, তবে কোনভাবেই দুই পাতার বেশি সিভি লেখা উচিৎ না। চাকরিদাতা একটি সিভি দেখার জন্য গড়ে ৩০ সেকেন্ডের বেশি সময় দেন না। তাই সিভির তথ্যগুলো যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত ও প্রাসঙ্গিক রাখুন, যাতে করে এটি সিভি পাঠকের বিরক্তির কারণ না হয়ে ওঠে।
PDF নাকি Word: অনেক কোম্পানি হার্ড কপির পরিবর্তে সিভির ডিজিটাল কপি অর্থাৎ PDF বা Word কপি চেয়ে থাকে। তাই আপনার লেখা শেষ হয়ে গেলে সিভি লে-আউট অক্ষত আছে কিনা তা নিশ্চিত করার জন্য PDF ভার্সনে সিভিটি সংরক্ষণ করুন। তবে কিছু নিয়োগকর্তা PDF ভার্সনের সিভি গ্রহণ করেন না। যদি এমন হয়, তাহলে আপনার সিভি Microsoft Word – এ পাঠান।
শেষ কথা
সঠিক চাকরি পাওয়া আপনার ক্যারিয়ারের একটি মাত্র ধাপ। এখনো অনেক কিছু শেখার বাকি আছে। তাই সিভি লেখার নিয়ম মেনে চমৎকারভাবে নিজেকে উপস্থাপন করুন। যদিও কোন কারণে আপনি চাকরিটি না পান, তথাপি স্মার্ট একটি সিভির জন্য চাকরিদাতার মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে না।
সর্বদাই খেয়াল রাখুন, সিভিই হচ্ছে চাকরীদাতা এবং আপনার মধ্যে পরিচয়ের প্রথম মাধ্যম। সুতরাং এর সৌন্দর্য আপনার সৌন্দয্যেরই প্রতিনিধিত্ব করে। সিভিতে যেমন প্রয়োজনীয় সব তথ্য সরবারহ করা উচিৎ, একইসাথে উচিৎ তথ্যগুলো সুন্দরভাবে সাজানো। তাই সিভি তৈরি শেষে অভিজ্ঞ কাউকে দেখিয়ে একবার রিভিশন করিয়ে নিতে পারেন।
এছাড়াও আমাদের দেয়া নমুনা সিভিগুলো দেখে নিজের একটি সিভি তৈরি করতে পারেন। এই ডাউনলোড লিংকে ক্লিক করে আমাদের নমুনা ফাইলগুলো Microsoft Word ফরমেটে ডাউনলোড করে নিন। নিজের তথ্য দিয়ে ফাইলটি পূরণ করে প্রয়োজনমত প্রিন্ট করে নিন।