ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে শারীরিক ইবাদতের দিক দিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সালাত আদায় করা। আর্থিক ইবাদতের দিক দিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যাকাত দেওয়া। সবার উপর যাকাত ফরজ নয়। কেবল যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত গুলো অনুযায়ী আপনার উপর যদি সকল শর্ত প্রতিফলিত হয় তাহলেই আপনার উপর যাকাত ফরজ হবে।
ইসলামী আইন মোতাবেক প্রতি বছর মুসলমানদের নিজের অর্থের উপর একটি অংশ যাকাত হিসেবে গরীব দুঃখীদেরকে দিতে হবে। প্রতিটি ব্যক্তি সুষ্ঠভাবে যাকাত প্রদান করলে দারিদ্রতার হার কমতে শুরু করবে। যাকাত দিলে শুধু মালের পবিত্রতা রক্ষা হয় তা নয় বরং যাকাতের ফলে ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রের অনেক ধরনের উপকার হয়।
যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত
আল্লাহ তায়ালা বলেন, (হে নবী!) তাদের সম্পদ থেকে যাকাত গ্রহণ করুন, যা দ্বারা আপনি তাদের সম্পদকে পরিশুদ্ধ করবেন, তাদের জন্য দোয়া করুন। নিশ্চয়ই আপনার দোয়া তাদের জন্য প্রশান্তিদায়ক। আর আল্লাহ সব শোনেন ও সব জানেন। (সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ১০৩)
আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন, হে মুমিনগণ! তোমরা তোমাদের বৈধ উপার্জন এবং তোমাদের ভূমি থেকে উৎপন্ন শস্য হতে কিছু শস্য আল্লাহর নির্দেশিত পথে ব্যয় কর। (সূরা বাকারা ২৬৭ নং আয়াত)
আরো পড়ুন : ফজরের দুই রাকাত সুন্নত নামাজ পড়ার নিয়ম ও দোয়া
যে সম্পদের উপর ইতিমধ্যে যাকাত ফরজ হয়েছে সেসব সম্পদ হতে ৪০ ভাগের এক ভাগ তথা ২.৫% সম্পদ যাকাত দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। চলুন আমরা যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য হাদিসে কি কি শর্তের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা হচ্ছে-
- মুসলিম হওয়া
- প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া
- বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন হওয়া
- স্বাধীন ব্যক্তি হওয়া
- নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকা
- সম্পদের উপর মালিকানা
- সম্পদ একবছর অধিকারে থাকা
- ঋণমুক্ত হওয়া
- হারাম সম্পদের যাকাত
- মৃত ব্যক্তির যাকাত
মুসলিম হওয়া
যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত গুলোর মধ্যে প্রথম শর্ত হচ্ছে মুসলিম হওয়া। যাকাত মুসলিমদের একটি ইবাদত। তাই মুসলিম ছাড়া অন্যান্য ব্যক্তির উপর যাকাত ফরজ নয়।
প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া
যাকাত ফরজের দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া। নাবালেগ শিশুর উপর থেকে যাকাত তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে, শিশু যদি সম্পদশালী হয় তবে তার দায়িত্বপ্রাপ্ত অভিভাবককে সেই শিশুর পক্ষ হতে যাকাত দিতে হবে। তবে, হানাফী মাযহাব মতে, শিশু সম্পদশালী হলেও প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত কোন যাকাত দিতে হবে না।
অধিকাংশ আলেমই মনে করেন শিশু সম্পদশালী হলে তার দায়িত্বপ্রাপ্ত অভিভাবককে সেই শিশুর সম্পদ হতে যাকাত দিতে হবে। অধিকাংশ হাদিসই মতে সম্পদশালী শিশুর জন্য যাকাত দেওয়াই উত্তম।
যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত : বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন হওয়া
যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত গুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন হতে হবে। যাকাত দেওয়ার জন্য ব্যক্তিকে অবশ্যই সজ্ঞানে থাকতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যক্তির যদি বিবেক-বুদ্ধি লোপ পায় কিংবা ব্যক্তি পাগল হয়ে থাকে তাহলে সেই ব্যক্তিকে যাকাত দিতে হবে না।
স্বাধীন ব্যক্তি হওয়া
দাস-দাসীদের উপরে যাকাত ফরজ নয়। দাস-দাসীদের নিজস্ব কোন সম্পদ থাকে না। যদিও দাসের সম্পদ থাকে তবে, সেটিও তার মনিবেরই। তাই দাস-দাসীদেরকে যাকাত দিতে হবে না।
নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকা
বছর শেষে যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে তাহলে সেই ব্যক্তিকে যাকাত দিতে হবে। নিসাব পরিমাণ সম্পদ হচ্ছে বছর শেষে নির্দিষ্ট একটি পরিমাণ টাকা বা সম্পদ মজুদ থাকা। এই নিসাবের পরিমাণ সাড়ে সাত তোলা সোনা বা আশি হাজার টাকা। এই সম্পদের উপর ২.৫% হাড়ে যাকাত দিতে হবে।
যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত : সম্পদের উপর মালিকানা
যাকাত দেওয়ার জন্য ব্যক্তির সম্পদ নিজস্ব মালিকানা ভুক্ত হোক বা যৌথ মালিকানা ভুক্ত হোক ব্যক্তির নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে তাকে যাকাত দিতে হবে। এক্ষেত্রে পূর্ণ মালিকানা হলে বছর শেষে যদি তার নিসাব পরিমাণ সম্পদ থেকে তাহলে সেই ব্যক্তি সেই সম্পদের যাকাত দিবে।
যদি যৌথ মালিকানা হয়ে থাকে তাহলে তার নিজস্ব যতটুকু সম্পদ সেই সম্পদ যদি নিসাব পরিমাণ হয় তাহলে সেই সম্পদের যাকাত দেবে। সম্পদ নিসাব পরিমাণ না হলে যাকাত দিতে হবে না।
সম্পদ একবছর স্থায়ী থাকা
যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত গুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হচ্ছে সম্পদ একবছর স্থায়ী হতে হবে। নিসাব পরিমাণ সম্পদ যদি পুরো বছর নিজের কাছে থাকে তাহলে তাকে সেই সম্পদের যাকাত দিতে হবে। কোন সম্পদ যদি এক বছরের কম সময় নিজের অধিকারে না থাকে তাহলে সেই সম্পদের যাকাত দিতে হবে না। এই সম্পদ হতে পারে অর্থ, সোনা-রুপা, চতুষ্পদ জন্তু ও ব্যবসায়িক পণ্য।
যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত : ঋণমুক্ত হওয়া
কোন ব্যক্তির যদি ঋণ থেকে থাকে তাহলে সেই ঋণ তাকে আগে পরিশোধ করতে হবে। ঋণ পরিশোধ করার পরে যদি উক্ত ব্যক্তির কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে তাহলে সেই সম্পদের উপর যাকাত দিতে হবে।
হারাম সম্পদের যাকাত
সম্পদ যদি হারামভাবে অর্জিত হয় তাহলে সেই সম্পদের যাকাত দিতে হবে না। হারামভাবে যে ব্যক্তি উপার্জন করে। সেই ব্যক্তির সম্পদ তার নিজের সম্পদ নয়। সে অন্য কারো কাছ থেকে তা হারাম উপায়ে নিয়ে এসেছে। যাকাত প্রদানের একটি শর্ত হচ্ছে সম্পদ নিজের হতে হবে। এই ব্যক্তির সম্পদ তার নিজের নয়, তা অন্য কারো। তাই এই ব্যক্তির উপর যাকাত ফরজ নয়।
মৃত ব্যক্তির যাকাত
কোন ব্যক্তির যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে এবং তিনি যাকাত আদায় না করে মারা যান তাহলে তার মৃত্যুর পরে তার সম্পদের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা তার ওয়ারিশগণ সেই ব্যক্তির পক্ষ হতে যাকাত আদায় করতে হবে।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত কিছু প্রশ্ন ও উত্তর
প্রশ্ন: শিশু ও পাগলকে কি যাকাত দিতে হবে?
উত্তর: বিষয়টি মতবিরোধপূর্ণ । কোন আলেমের মতে নিসাব পরিমাণ সম্পত্তি থাকলে পাগল ও শিশুর অভিভাবক তার যাকাত আদায় করবে। কোন আলেমের মতে শিশু ও পাগলকে যাকাত দিতে হবে। তবে, নিসাব পরিমাণ সম্পত্তি থাকলে যাকাত দিতে হবে এটি অধিক গ্রহণযোগ্য।
প্রশ্ন: একাধিক বছর যাকাত না দিলে কি করণীয়?
উত্তর: সঠিক নিয়মানুযায়ী নামাজ পড়া যেমন ইবাদত যাকাত দেওয়াও তেমন একটি ইবাদত। যাকাত না দিলে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে আগের বছরের যাকাতের হিসেব করে সেই অনুযায়ী যাকাত দিয়ে দিতে হবে।
প্রশ্ন: স্বর্ণ ছাড়া অন্যান্য মূল্যবান ধাতু থাকলে কি হিসেবে যাকাত দেবো?
উত্তর: বর্তমান সময়ে সেই ধাতুর বাজারদর অনুযায়ী ২.৫% যাকাত দিতে হবে।
শেষ কথা
ইসলামের অন্যান্য বিধানের মতো যাকাতও খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিধান। সবাই যাকাত দিলে শুধু মাল পবিত্র হয় তা নয় বরং সমাজ ও রাষ্ট্রের উপকারও হয়। তাই প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত গুলো মেনে যাকাত দেওয়া।