ক্ষণস্থায়ী জীবনে আমরা অনেকেই লাইফ ইন্সুরেন্স কি বা লাইফ ইন্সুরেন্স এর সুবিধা কি তা জানি না। ফলে না জেনেই আমরা এ বিষয়ে অজ্ঞ থেকে যাই এবং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কিছু সঞ্চয়ের ব্যবস্থা না করেই পৃথিবী থেকে বিদায় নেই। আজকের আমরা চেষ্টা করব লাইফ ইন্সুরেন্সের খুটনাটি এবং কেন আপনার লাইফ ইন্স্যুরেন্স করা উচিত সেটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার।
আমরা অনেকেই ভাবি, জীবন বীমা কেন করব? এত ঝামেলা পোহানোর কি দরকার। কিন্তু একবার ভেবে দেখুন, আপনার ওপর হয়তো আপনার পরিবার এককভাবে নির্ভরশীল। আপনি নিজে যেকোন সময় দুর্ঘটনা কিংবা যেকোন মরণঘাতী রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে পারেন। সেই ক্ষেত্রে তাদের কি হবে?
তাই এমন আরো হাজারো সম্ভাব্য সমস্যার একটি সমাধান হচ্ছে জীবন বীমা। জীবন বীমায় আপনি আপনার পরিবারের জন্য একটি নিশ্চিত সঞ্চয় রেখে যেতে পারবেন যে কোন অনাকাংখিত ঘটনার জন্য।
লাইফ ইন্সুরেন্স কি?
জীবন বীমা বা লাইফ ইন্সুরেন্সের সুবিধা জানার আগে জেনে চলুন জেনে নেই এটি মূলত কি? খুব সাধারণভাবে বলতে হলে এটি হল এক ধরনের সঞ্চয় যেখানে আপনি প্রতি মাসে নির্দিষ্ট একটি পরিমাণ টাকা জমা দেবেন এবং পরবর্তীতে আপনার যেকোন দুর্ঘটনা কিংবা ক্ষতির সময় বীমা কোম্পানী আপনাকে তাদের সেই প্রতিশ্রুত অর্থটি দেবে।
বুঝতে একটু কঠিন হয়ে গেল? সাধারণত ব্যাংকে আমরা যখন সেভিংস একাউন্ট খুলি তখন আমরা প্রতি মাসে নির্দিষ্ট কিছু লভ্যংশের বিনিময়ে কিছু টাকা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য জমাই। নির্দিষ্ট সময় পরে সেই টাকা আমরা সুদে-মূলে তুলে নেই। কিন্ত বীমার ক্ষেত্রে তেমনটি নয়।
মনে করুন, আপনি একটি ৫ লক্ষ টাকার জীবন বীমা করলেন। যেখানে আপনাকে প্রতি মাসে ৩ হাজার টাকা প্রিমিয়াম দিতে হবে। কিন্তু এই ৩ হাজার টাকার জন্য বীমা কোম্পানী আপনাকে কোন লাভ দেবে না। বরং অনাকাঙ্খিত কোন দুর্ঘটনায় কিংবা অসুখে আপনার মৃত্যু হলে তারা সেই ৫ লক্ষ টাকা আপনার পরিবারের হাতে হস্তান্তর করবে যা আপনার পরিবারের জন্য একটি আর্থিক সাহায্য হবে।
তাহলে সোজা ভাষায় জীবন বীমা হচ্ছে এমন একটি চুক্তি বা জামিন ব্যবস্থা, যেখানে আপনি নির্দিষ্ট একটি মাসিক টাকা জমা দেয়ার মাধ্যমে ভবিষ্যতের যে কোন অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনায় আপনার মৃত্যুর পরে আপনার পরিবারকে ক্ষতিপূরণের অর্থ প্রদানের জন্য বীমা কোম্পানীর সাথে চুক্তিবদ্ধ হলেন।
লাইফ ইন্সুরেন্স এর সুবিধা
যেহেতু এর মাধ্যমে আপনি জরুরি অবস্থায় বিশেষ সাহায্য পেয়ে থাকেন, তাই লাইফ ইন্সুরেন্স এর সুবিধা অনেক। এর ফলে আপনি ও আপনার পরিবার বিশেষ কোন অপ্রত্যাশিত দুর্যোগ মোকাবেলায় আগে থেকেই প্রস্তুত থাকতে পারে। লাইফ ইন্সুরেন্সের বেশকিছু সুবিধা রয়েছে। নিচে তা ধারাবাহিকভাবে উল্লেখ করা হলো।
১. মৃত্যু পরবর্তী সুবিধা
যদি বীমাকৃতের কোন অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে, যার ফলে তাদের পরিবারের আয়ের ক্ষতি হয়, তাহলে বীমা কোম্পানি তাদের মৃত্যু বেনিফিট আকারে ক্ষতিপূরণ দেয়। নিয়োগপ্রাপ্ত প্রার্থী প্রতিশ্রুত পুরো টাকা এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জমা হওয়া বোনাস পান।
মৃত্যু সুরক্ষা প্রদান ছাড়াও অনেক জীবন বীমা পরিকল্পনা মাসিক আয়ের সুবিধা প্রদান করে। এধরনের বীমা অবসর বয়সে পৌঁছেছে এবং আয় হ্রাস পাচ্ছে এমন ব্যক্তিদের জন্য একটি চমৎকার সুবিধা।
তবে জীবন বীমা পাওয়ার সময় বেশ কয়েকটি পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য এবং সুবিধাগুলো মূল্যায়ন করতে সতর্ক থাকতে হবে এবং সর্বোত্তম সুরক্ষা প্রদানের জন্য আপনার প্রয়োজনীয়তার জন্য সেরাটি নির্বাচন করতে হবে।
২. বিনিয়োগের উপর প্রাপ্তি
প্রখ্যাত আর্থিক উপদেষ্টারা পরামর্শ দেন যে, প্রত্যেকেরই জীবন বীমা পলিসিতে বিনিয়োগ করা উচিত। শুধুমাত্র পরিবারের আর্থিক নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য নয়, যখন আপনি সেখানে থাকবেন না, একই সাথে বিনিয়োগে চমৎকার রিটার্ন পাওয়ার জন্যও।
উপরন্তু, অন্যান্য বিনিয়োগ বিকল্পের সাথে তুলনা করলে জীবন বীমা একটি নিরাপদ আর্থিক উপকরণ। মেয়াদ শেষে বা বীমাকারীর মৃত্যুর পর আপনি যে অর্থ বীমাতে বিনিয়োগ করেছেন তা আপনাকে গ্যারান্টিযুক্ত অর্থ হিসাবে সম্পূর্ণ পরিশোধ করা হবে।
৩. কর সুবিধা
একটি উল্লেখযোগ্য লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সুবিধা হল কর সুবিধা। আপনি যদি একজন বেতনভোগী কর্মচারী হন এবং একটি জীবন বীমা পলিসি কিনে থাকেন, তাহলে আপনি একটি ছাড়ের (Discount) জন্য যোগ্য হতে পারেন।
৪. লোন সুবিধা
জরুরী পরিস্থিতিতে যখন আপনার টাকা দরাকর, আপনি জীবন বীমা কভারেজের বিপরীতে ঋণ নিতে পারেন। প্রায় সব বড় বীমা সংস্থাগুলি এখন পলিসিহোল্ডারদের বীমার বিপরীতে ঋণ সুবিধা সরবরাহ করে।
পলিসির শর্তের ওপর নির্ভর করে আপনি বীমার নগদ মূল্যের একটি নির্দিষ্ট অনুপাত বা বীমাকৃত অর্থের ধার নিতে পারেন। তাই আপনি বীমার জন্য চুক্তিবদ্ধ হওয়ার আগে বীমাকারীর সাথে ঋণ গ্রহণ নীতি ভালোভাবে জেনে নিন।
৫. আর্থিক পরিকল্পনার সঠিক সিদ্ধান্ত
জীবনের ধাপগুলো অতিক্রম করার সময় আপনার আর্থিক সিদ্ধান্তগুলো সাবধানে পরিকল্পনা করা গুরুত্বপূর্ণ। লাইফ ইন্স্যুরেন্স ঠিক এই ক্ষেত্রে আপনাকে সাহায্য করতে পারে। আপনি আপনার অকাল মৃত্যুর ক্ষেত্রে পরিবারকে আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য বিভিন্ন মেয়াদী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সুবিধা ব্যবহার করতে পারেন।
এটি কেবল তাদের আর্থিক দায়িত্ব পালনে সাহায্য করবে তা নয়, এটি তাদের জীবনযাপনে ব্যাঘাত না করে আর্থিকভাবে স্বাধীন জীবনযাপনের সুবিধা দেবে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে যেমন ছেলে-মেয়েদের বিয়ে, পনার সন্তানের স্কুলের পড়াশোনার জন্য অর্থ প্রদান এবং অবসর পরবর্তী জীবনের জন্য একটি স্বপ্নের ঘর নির্মাণ করা ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিশাল সহযোগিতা করবে।
৬. নিশ্চিত আয়ের উৎস
লাইফ ইন্সুরেন্স এর সুবিধা গুলোর মধ্যে আরেকটি হচ্ছে নিশ্চিত আয়ের উৎস। আপনার পরিবার আপনার উপস্থিতিতে আর্থিকভাবে নিরাপদবোধ করে। কারণ আপনি তাদের প্রয়োজন মেটাতে নিয়মিত আয় করেন। আপনি যে উপার্জন করছেন তা ঋণ পরিশোধ (যদি থাকে), বাসা ভাড়া, দৈনিক বিল, শিশুদের শিক্ষা এবং অন্যান্য গৃহস্থালির খরচ পরিশোধে সহায়তা করে।
কিন্তু কি হবে যদি আপনি হঠাৎ চলে যান এই পৃথিবী ছেড়ে? কিছু জীবন বীমা পলিসি নিয়মিত পে-আউট প্রদান করে, যা পরিবারের উপার্জনকারী সদস্যের মৃত্যুর কারণে আয়ের ক্ষতি পূরণ করতে পারে।
৭. ব্যবসায়িক নিরাপত্তা
বর্তমানে বেশ কয়েকটি জীবন বীমা কোম্পানি রয়েছে যারা তাদের বীমা পলিসি এর সাথে একটি সুবিধা দেয়। যদি আপনি যদি পলিসি কিনে থাকেন এবং ব্যবসা পরিচালনা করেন, তাহলে আপনার ব্যবসায়িক সঙ্গী পলিসিধারীর মৃত্যুর পর পলিসি হোল্ডারের একটি অংশ কিনতে পারেন।
এক্ষেত্রে, ব্যবসায়িক অংশীদারকে জীবন বীমা কোম্পানির সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করতে হবে এবং শেয়ার বিক্রির পর প্রাপ্ত অর্থ পরিশোধ করা হবে পলিসিধারীর মনোনীত ব্যক্তিকে। এটা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে পলিসি হোল্ডারদের উপর নির্ভরশীল বা মনোনীত ব্যক্তি কোম্পানিতে কোন অংশীদারিত্ব পান না।
লাইফ ইন্সুরেন্স কিভাবে করবেন?
লাইফ ইন্সুরেন্স এর সুবিধা সম্পর্কে জানলেন, এবার তাহলে জেনে নেয়া যাক এটি করবেন কিভাবে। উপযুক্ত লাইফ ইন্স্যুরেন্স কিনতে হলে বুঝতে হবে আপনার প্রয়োজন কি ধরনের এবং আপনি কত টাকা প্রিমিয়ামের বীমা কিনতে চাচ্ছেন। কারণ যে প্রিমিয়াম যত বেশী হবে মেয়াদ শেষ হওয়ার পর কিংবা ক্ষতিপূরণ আদায়ের সময় আপনার প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণও হবে বেশী।
তবে মনে রাখবেন, শুধু প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণ বেশী হলেই যে সেটা আপনার জন্য লাভজনক তা কিন্তু নয়। আরো বেশ কিছু জিনিস আপনাকে বিবেচনায় রাখতে হবে, যেমন প্রিমিয়াম পলিসি, রিটার্ন পলিসি, ট্যাক্স পলিসি, নমিনী পলিসি, ম্যাচুরিটি সুবিধা ইত্যাদি।
সর্বপ্রথম আপনি ঠিক করে নিন আপনি কয় বছর মেয়াদী বীমা চাচ্ছেন এবং প্রতি মাসে কি পরিমাণ প্রিমিয়াম আপনি জমা দেবেন। বর্তমানে দুই ধরনের জীবন বীমা আপনি পাবেন। একটি নির্দিষ্ট সময়ের বীমা এবং অপরটি লাইফ টাইম বীমা। এর পাশাপাশি পলিসির কভারেজ এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধা সম্পর্কেও জেনে নেবেন।
মনে রাখবেন, এটি আপনার একটি সম্পদ যা পরিবারের জন্য আপনি করছেন। তাই শুধু মাত্র নির্দিষ্ট কোন একটি বীমা কোম্পানীর বিজ্ঞাপন কিংবা এজেন্টের কথায় বিমোহিত না হয়ে নিজে রিসার্স করুন কোন প্রতিষ্ঠানটি আপনার জন্য সেরা অফারটি দিচ্ছে। লোকাল কোন বীমা এজেন্ট থেকে বীমা না নিয়ে সরাসরি বীমা অফিসে যোগাযোগ করে সিদ্ধান্ত নিন।
চূড়ান্ত্র সিদ্ধান্ত নেয়ার পরে আপনার নিজস্ব কাগজপত্র যেমন জাতীয় পরিচয়পত্র, ড্রাইভিং লাইসেন্স, পাসপোর্ট, আয়ের উৎসের প্রমাণপত্র এবং নমিনির কাগজপত্র ইত্যাদি গিছিয়ে রাখুন। সবশেষে বীমা এজেন্ট কিংবা অফিসারের সাথে বসে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি দিয়ে ফর্ম পুরণ করুন এবং প্রিমিয়ামের প্রথম টাকাটি পরিশোধ করুন।
লাইফ ইন্সুরেন্স প্রতারণা
আপনি হয়তো অদূর ভবিষ্যতের চিন্তায় অনেক চিন্তা ভাবনা করে কষ্টার্জিত আয় থেকে প্রতি মাসে প্রিমিয়ামের টাকা জমা দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু হঠাৎ জানতে পারলেন আপনার বীমা এজেন্ট ছিলেন একজন প্রতারক এবং সে আপনার মত আরো অনেকের প্রিমিয়ামের টাকা নিয়ে হাওয়া।
এই ধরনের ঘটনা আমাদের বাংলাদেশে অহরহ ঘটে চলেছে। বীমা এজেন্ট সেজে কিংবা ভুয়া বীমা কোম্পানী খুলে অল্প প্রিমিয়ামে অধিক সুবিধার লোভ দেখিয়ে অনেক প্রতারকই হাতিয়ে নিচ্ছে মানুষের কষ্টার্জিত টাকা।
তাই যেকোন বীমা কেনার আগে তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড, অথেন্টিসিটি, এজেন্টের সত্যতা, অফিসের সত্যতা, কোম্পানী রিভিউ এবং তাদের ওয়েবসাইট সব কিছু দেখে নেবেন। সবচেয়ে ভালো হয় যদি সবকিছু নিজে সরেজমিনে দেখে নিশ্চিত হয়ে নিতে পারেন। কোন চটকদার বিজ্ঞাপন কিংবা অধিক লাভের লোভে সবকিছু হারাবেন না।
শেষ কথা
দীর্ঘ এ আলোচনায় আমরা লাইফ ইন্সুরেন্স এর সুবিধা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপস্থাপনের চেষ্টা করেছি। পাশাপাশি বীমা নিয়ে প্রতারণাকারীদের থেকে বেচে থাকার কৌশল সম্পর্কেও বিস্তারিত বলেছি। তাহলে আর দেরী না করে এখনই কাজে নেমে পড়ুন।
কারণ আপনার একটি সঠিক সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতের যেকোন দুর্ঘটনায় আপনার পরিবারকে আর্থিকভাবে নিরাপত্তা প্রদান করবে। মনে রাখবেন, আপনার এই সিদ্ধান্ত আপনার অনুপস্থিতিতেও আপনার পরিবারকে সাহায্য করবে এবং আপনি থাকবেন তাদের দোয়ায় এবং প্রতি মূহুর্তের স্মরণে।