বার্ষিক গতি ও বার্ষিক গতির ফলাফল

Preparation BD
By -
0

বার্ষিক গতি

পৃথিবী নিজ অক্ষে অবিরাম ঘুরতে ঘুরতে একটি নির্দিষ্ট উপবৃত্তাকার কক্ষপথে, নির্দিষ্ট দিকে এবং নির্দিষ্ট সময়ে সূর্যের চারদিকে পরিক্রমণ করছে। পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে পৃথিবীর এ পরিক্রমণকে বার্ষিক গতি (Annual Motion) বলে। পৃথিবীর সূর্যকে পরিক্রমণ করতে এক বছর সময় লাগে। এ সময়কে সৌরবছর বলা হয়। এ গতির বেগ প্রতি সেকেন্ডে ২৯.৭৬ কিলোমিটার। বার্ষিক গতিতে পৃথিবী যে পথ অতিক্রম করে তার দৈর্ঘ্য ৯৩ কোটি ৮০ লক্ষ ৫১ হাজার ৮২৭ কিলোমিটার এবং সময় লাগে ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৪৭ সেকেন্ড। প্রতি ৪ বছরে একদিন বাড়িয়ে ৩৬৬ দিনে বছর গণনা করা হয়। সে বছর ফেব্রুয়ারি মাস ২৮ দিনের পরিবর্তে ২৯ দিনে ধরা হয়। এরূপ বছরকে অধিবর্ষ বা Leap Year বলে।

বার্ষিক গতির ফলাফল

বার্ষিক গতির ফলে পৃথিবীতে দিনরাত্রির হ্রাস-বৃদ্ধি ও ঋতু পরিবর্তন ঘটে।

দিনরাত্রির হ্রাস-বৃদ্ধির কারণ : 

(১) পরিক্রমণকালে পৃথিবীর মেরুরেখা ধ্রুবতারাভিমুখী হয়ে কক্ষতলের সঙ্গে সর্বদাই প্রায় ৬৬.৫° কোণে হেলে থাকে।

(২) নিরক্ষরেখার সমতল কক্ষতলের সঙ্গে সর্বদাই ২৩.৫° কোণে হেলে থাকে।

(৩) পৃথিবীর অক্ষরেখা সকল অবস্থানেই পরস্পর সমান্তরাল থাকে ।

প্রক্রিয়া : সূর্যকে পরিক্রমণকালে কক্ষপথে পৃথিবীর চারটি অবস্থান নির্দিষ্ট করা হয়েছে। যথা- ২১শে জুন, ২৩শে সেপ্টেম্বর, ২২শে ডিসেম্বর ও ২১শে মার্চ।

২১শে জুন : পৃথিবী সূর্যের চারদিকে পরিক্রমণকালে ২১শে জুন কক্ষপথে এমন এক অবস্থানে পৌঁছে যেখানে উত্তর মেরু সূর্যের দিকে সর্বাপেক্ষা বেশি (২৩.৫°) ঝুঁকে থাকে এবং দক্ষিণ মেরু সূর্য থেকে সর্বাপেক্ষা দূরে সরে পড়ে ৷ এই দিন মধ্যাহ্নে ২৩.৫° উত্তর অক্ষাংশে (কর্কটক্রান্তি রেখায়) সূর্যকিরণ লম্বভাবে (৯০° কোণে) পড়ে। এ দিন উত্তর গোলার্ধে দিন সবচেয়ে বড় এবং রাত্রি সবচেয়ে ছোট হয়। দক্ষিণ গোলার্ধে বিপরীত অবস্থা বিরাজ করে। সুমেরুবৃত্ত (৬৬.৫° উত্তর) থেকে উত্তরে উত্তর মেরু পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টা দিন ও কুমেরুবৃত্ত (৬৬.৫° দক্ষিণ) থেকে দক্ষিণে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টা রাত থাকে। এই দিন সূর্য উত্তরায়ণের শেষ সীমায় পৌঁছে বলে এই দিনকে সূর্যের উত্তর অয়নান্ত বলে ।

 

বার্ষিক গতি ও বার্ষিক গতির ফলাফল

 

আরো পড়ুন : আগস্ট মাসে যে বিখ্যাত ব্যক্তিদের মৃত্যু

২৩শে সেপ্টেম্বর : ২১শে জুনের পর উত্তর মেরু সূর্য থেকে দূরে সরতে থাকে এবং দক্ষিণ মেরু নিকটে আসতে থাকে । এতে উত্তর গোলার্ধে ক্রমশ দিন ছোট ও রাত বড় এবং দক্ষিণ গোলার্ধে দিন বড় ও রাত ছোট হতে থাকে। ২৩শে সেপ্টেম্বর পৃথিবী এমন এক স্থানে অবস্থান করে যখন উভয় মেরু সূর্য থেকে সমান দূরে থাকে। এই দিন সূর্যরশ্মি নিরক্ষরেখায় ৯০° কোণে, সুমেরুবৃত্তে ও কুমেরুবৃত্তে ৬৬.৫° কোণে এবং মেরুদ্বয়ে ০° কোণে পতিত হয়। তাই এই দিন পৃথিবীর সর্বত্র দিনরাত্রি সমান হয় এবং এই দিনকে শারদ বিষুব বলে। ২১শে মার্চ থেকে ২৩শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছয় মাস উত্তর মেরুতে অবিরত দিন ও দক্ষিণ মেরুতে অবিরত রাত থাকে।

 

২২শে ডিসেম্বর : ২৩শে সেপ্টেম্বরের পর উত্তর মেরু সূর্য থেকে আরো দূরে সরতে থাকে এবং দক্ষিণ মেরু অপেক্ষাকৃত নিকটবর্তী হয়। ফলে উত্তর গোলার্ধে দিনের পরিমাণ কমতে থাকে এবং রাত্রি বড় হতে থাকে। এভাবে ২২শে ডিসেম্বর পৃথিবী এমন এক অবস্থানে পৌঁছে যখন দক্ষিণ মেরু সূর্যের দিকে সবচেয়ে বেশি হেলে থাকে (২৩.৫°)। এই দিন সূর্যকিরণ মকরক্রান্তি রেখায় লম্বভাবে (৯০° কোণে) পতিত হয়। এ তারিখে দক্ষিণ গোলার্ধে দিন সবচেয়ে বড় এবং রাত সবচেয়ে ছোট হয়। উত্তর গোলার্ধে এর বিপরীত অবস্থা বিরাজ করে। দক্ষিণায়নে এটি সূর্যের শেষ অবস্থান। একে দক্ষিণ অয়নান্ত বলে। এই দিন ৬৬.৫° উত্তর অক্ষাংশ থেকে উত্তরে উত্তর মেরু পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টা রাত্রি এবং ৬৬.৫° দক্ষিণ অক্ষাংশ থেকে দক্ষিণে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টা দিন হয় ।

 

২১শে মার্চ : ২২শে ডিসেম্বরের পর পৃথিবী আপন কক্ষপথে আরো অগ্রসর হলে উত্তর মেরু ক্রমশ সূর্যের নিকটে আসে এবং দক্ষিণ মেরু দূরে সরে যায়। এতে উত্তর গোলার্ধে দিন বড় এবং রাত ছোট হতে থাকে। অবশেষে ২১শে মার্চ পৃথিবী আপন কক্ষপথের এমন এক স্থানে পৌঁছে যেখানে উভয় মেরু সূর্য থেকে সমান দূরে থাকে। এই দিন ২৩শে সেপ্টেম্বরের মতো দিনরাত্রি সমান হয়। পৃথিবীর এ অবস্থাকে বাসন্ত বিষুব বলে। ২৩শে সেপ্টেম্বর থেকে ২১শে মার্চ পর্যন্ত ছয় মাস উত্তর মেরুতে অবিরত রাত এবং দক্ষিণ মেরুতে অবিরত দিন থাকে। ২১শে মার্চের পর পৃথিবী আপন কক্ষপথে ঘুরতে ঘুরতে পুনরায় ২১শে জুনের অবস্থায় ফিরে যায়। এভাবে পৃথিবীর বার্ষিক গতির জন্য দিনরাত্রির হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে ।

 

ঋতু পরিবর্তন

 

বার্ষিক গতির জন্য সূর্যরশ্মি কোথাও লম্বভাবে আবার কোথাও তির্যকভাবে পতিত হয় এবং দিনরাত্রির হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। লম্বভাবে পতিত সূর্যরশ্মি কম বায়ুস্তর ভেদ করে আসে বলে ভূপৃষ্ঠকে অধিক উত্তপ্ত এবং তির্যকভাবে পতিত সূর্যরশ্মি যে কেবল অধিক বায়ুস্তর ভেদ করে আসে তা নয়, এটি লম্বভাবে পতিত রশ্মি অপেক্ষা অধিক স্থানব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে । এর ফলে লম্বভাবে পতিত রশ্মি অপেক্ষা তির্যকভাবে পতিত রশ্মি এলাকায় উত্তাপের পরিমাণ কম হয়। আবার কোনো স্থানে রাত অপেক্ষা দিন বড় হলে সে স্থানে বায়ুমণ্ডল অধিক উত্তপ্ত হয়। এতে বছরের বিভিন্ন সময়ে ভূপৃষ্ঠের সর্বত্র তাপের তারতম্য হয় এবং ঋতু পরিবর্তন ঘটে।

 

বার্ষিক গতি ও বার্ষিক গতির ফলাফল

 

 

 

প্রক্রিয়া : সূর্যকে পরিক্রমণকালে পৃথিবীর চারটি অবস্থান থেকে ঋতু পরিবর্তনের ব্যাখ্যা পাওয়া যায় ।

 

উত্তর গোলার্ধে গ্রীষ্মকাল ও দক্ষিণ গোলার্ধে শীতকাল : ২১শে জুন সূর্যের উত্তরায়ণের শেষ দিন। এই দিন সূর্যরশ্মি কর্কটক্রান্তির ওপর লম্বভাবে পতিত হয়। ফলে এখানে ঐ দিন দীর্ঘতম দিন ও ক্ষুদ্রতম রাত্রি হয়। ২১শে জুনের দেড় মাস পূর্ব থেকে দেড় মাস পর পর্যন্ত মোট তিন মাস উত্তর গোলার্ধে উত্তাপ বেশি থাকে। এ সময় উত্তর গোলার্ধে গ্রীষ্মকাল। এ সময়ে সূর্যের তির্যক কিরণের জন্য দক্ষিণ গোলার্ধে দিন ছোট ও রাত বড় হয় বলে সেখানে তখন শীতকাল ।

 

উত্তর গোলার্ধে শরৎকাল ও দক্ষিণ গোলার্ধে বসন্তকাল : ২৩শে সেপ্টেম্বর সূর্যরশ্মি নিরক্ষরেখার ওপর লম্বভাবে পড়ে এবং সর্বত্র দিনরাত্রি সমান হয়। সেজন্য এ তারিখের দেড় মাস পূর্বে ও দেড় মাস পরে উত্তাপ মধ্যম রকমের হয়ে থাকে। এসময় উত্তর গোলার্ধে শরৎকাল ও দক্ষিণ গোলার্ধে বসন্তকাল ।

 

উত্তর গোলার্ধে শীতকাল ও দক্ষিণ গোলার্ধে গ্রীষ্মকাল : ২২শে ডিসেম্বর সূর্যের দক্ষিণায়নের শেষ দিন অর্থাৎ এই দিন সূর্য মকরক্রান্তির ওপর লম্বভাবে কিরণ দেয়। ফলে এখানে দিন বড় ও রাত্রি ছোট হয়। এ তারিখের দেড় মাস পূর্বে ও পরে দক্ষিণ গোলার্ধে গ্রীষ্মকাল এবং বিপরীত কারণে উত্তর গোলার্ধে শীতকাল থাকে ।

 

উত্তর গোলার্ধে বসন্তকাল ও দক্ষিণ গোলার্ধে শরৎকাল : ২১শে মার্চ তারিখে উত্তর ও দক্ষিণ মেরু সূর্য থেকে সমান দূরে থাকে। এই দিন সূর্য নিরক্ষরেখার ওপর লম্বভাবে কিরণ দেয় এবং সর্বত্র দিনরাত্রি সমান হয়। ২১শে মার্চের দেড় মাস পূর্ব থেকে দেড় মাস পর পর্যন্ত এই তিন মাস উত্তর গোলার্ধে বসন্তকাল ও দক্ষিণ গোলার্ধে শরৎকাল।

 

পৃথিবীতে প্রধানত চারটি ঋতু দেখা যায়। তবে জলবায়ুর বিশেষত্বের জন্য ঋতুর সংখ্যা কম বা বেশি হতে পারে। যেমন, আমাদের দেশে শীতের প্রথম ভাগকে হেমন্তকাল ও গ্রীষ্মের শেষ ভাগকে বর্ষাকাল বলে। আবার নিরক্ষরেখায় ঋতু পরিবর্তন হয় না। এখানে সর্বত্র দিনরাত্রি সমান। গ্রীষ্ম ঋতু এখানকার বৈশিষ্ট্য।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Accept !) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Accept !