২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ এদেশের ছাত্র-জনতা বুকের তাজা রক্তে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করে। তাই মহান ভাষা আন্দোলন বাঙালির জাতীয় জীবনে এক তাৎপর্যময় ঘটনা।
ভাষা আন্দোলন
ভাষা আন্দোলন বাঙালির ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। ১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্ভব হয় । স্বাধীনতার পরপরই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়।
২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ করাচিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান গণপরিষদ অধিবেশনে পরিষদ সদস্যদের উর্দু বা ইংরেজিতে বক্তৃতা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের কংগ্রেস দলের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এ প্রস্তাবে সংশোধনী এনে বাংলাকেও পরিষদের অন্যতম ভাষা করার দাবি জানান।
২১ মার্চ ১৯৪৮ পাকিস্তানের স্থপতি ও গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ঘোষণা দেন, ‘উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ । ২৪ মার্চ তিনি কার্জন হলে একই কথা বলেন । জিন্নাহ’র এ ঘোষণার প্রেক্ষাপটে পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
১১ মার্চ ১৯৫০ ‘বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। ২৬ জানুয়ারি ১৯৫২ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন পল্টন ময়দানে এক জনসভায় জিন্নাহ’র কথারই পুনরাবৃত্তি করেন। ফলস্বরূপ বাংলা ভাষার সমমর্যাদার দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে।
৩০ জানুয়ারি ১৯৫২ গঠিত ‘সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারি সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল, জনসভা ও বিক্ষোভ মিছিল আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয়। ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ নুরুল আমীন সরকার আন্দোলনের ভয়ে ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে মিছিল, সমাবেশ ইত্যাদি বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮) এ আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে নিহত হন সালাম-রফিক-জব্বার-বরকতসহ আরও অনেকে। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলন আরও বেগবান হয়।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস
একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের দাবি জানিয়ে ৯ জানুয়ারি ১৯৯৮ কানাডায় বসবাসরত বাংলাদেশি নাগরিক “মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনানকে চিঠি দেন।
২৩ জানুয়ারি ১৯৯৮ জাতিসংঘ থেকে জানানো হয় নিয়ম অনুযায়ী, এ সংস্থা কোনো ব্যক্তির আবেদন বিবেচনায় নিতে পারে না। আবেদন আসতে হবে জাতিসংঘের যেকোনো সদস্য রাষ্ট্রের কাছ থেকে। এ প্রেক্ষিতে রফিকুল ইসলাম কানাডা প্রবাসী আরেক বাংলাদেশি নাগরিক আবদুস সালামকে নিয়ে সাতটি ভিন্ন ভাষার ১০ জন সদস্য মিলে The Mother Language Lovers of the World নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেন।
২৯ মার্চ ১৯৯৮ এ সংগঠনের পক্ষ থেকে আবার ১০ সদস্যের স্বাক্ষর সংবলিত সেই একই প্রস্তাব জাতিসংঘে পাঠানো হয়। জাতিসংঘ মহাসচিবের অফিস প্যারিসে অবস্থিত UNESCO’র সাথে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেয়। ৪ এপ্রিল ১৯৯৯ UNESCO ফ্যাক্সে পাঁচটি দেশের নাম এবং তাদের UNESCO অফিসের ঠিকানা দিয়ে ঐ সব দেশকে প্রস্তাবটি জাতিসংঘে আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপনের অনুরোধ জানায়। দেশ পাঁচটি— কানাডা, ভারত, ফিনল্যান্ড, হাঙ্গেরি এবং বাংলাদেশ।
অবশেষে ৫ অক্টোবর-১৫ নভেম্বর ১৯৯৯ অনুষ্ঠিত UNESCO’র নির্বাহী পরিষদের ১৫৭তম অধিবেশনে প্রস্তাবটি স্বীকৃতি লাভ করে। এরপর UNESCO’র দ্বি-বার্ষিক ৩০তম সাধারণ সভার শেষ দিন অর্থাৎ ১৭ নভেম্বর ১৯৯৯ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতির প্রস্তাবটি উত্থাপিত হয়। সেদিনই প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদিত হয়। ২০০০ সালে প্রথমবারের মতো বিশ্বব্যাপী পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।