ওপেকের (OPEC) তেলের উৎপাদন কমিয়ে দেওয়ার পরিণতি

Preparation BD
By -
0

পুরাে নাম অর্গানাইজেশন অব দ্য পেট্রোলিয়াম এক্সপাের্টিং কান্ট্রিজ, সংক্ষেপে ওপেক। বাংলায় লেখা হয় জ্বালানি তেল রপ্তানিকারক দেশগুলাের সংগঠন। আলজেরিয়া, অ্যাঙ্গোলা, কঙ্গো, নিরক্ষীয় গায়ানা, গ্যাবন, ইরান, ইরাক, কুয়েত, লিবিয়া, নাইজেরিয়া, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ভেনেজুয়েলা— ১৩টি দেশ নিয়ে ওপেক গঠিত।

প্রতিষ্ঠা : ওপেক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৬০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইরাকের রাজধানী বাগদাদে।

প্রতিষ্ঠাতা সদস্য

ওপেকের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদেশ পাঁচটি— ইরান, ইরাক, কুয়েত, সৌদি আরব ও ভেনেজুয়েলা। এরপর বিভিন্ন সময় ইন্দোনেশিয়া, কাতার, ইকুয়েডর, গ্যাবন ওপেকে যােগদান করলেও থাকেনি। হয় তারা সদস্যপদ প্রত্যাহার করে নিয়েছে কিংবা বহিষ্কৃত হয়েছে।

সদর দপ্তর

ওপেকের সদর দপ্তর অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায়।

ওপেক প্লাস

একটি শব্দ প্রায়ই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আসে, তা হলাে ‘ওপেক প্লাস’। ওপেকভুক্ত ১৩টি দেশ এবং জ্বালানি তেল উৎপাদনকারী আরও বড় ১০টি দেশ মিলে হলাে ওপেক প্লাস জোট। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জ্বালানি তেল উৎপাদনকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু দেশটি ওপেক বা ওপেক প্লাসের সদস্য নয়। কানাডা ও চীন বিপুল পরিমাণে তেল উৎপাদনকারী রাষ্ট্র; কিন্তু ওই জোটে নেই। রাশিয়া আবার ওপেক প্লাসের সদস্য।

জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণে ভূমিকা

বিশ্বের জ্বালানি তেলের উৎপাদন ও আন্তর্জাতিক বাজারে দাম নির্ধারণে ওপেকভুক্ত দেশগুলাে বড় ভূমিকা রাখে। বিশ্বের দ্বিতীয় জ্বালানি তেল রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে সৌদি আরব ওপেকের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। অপর দিকে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মতাে যারা ওপেকের সদস্য নয়, তারা তাদের উৎপাদন ও রপ্তানির ক্ষেত্রে এককভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার রাখে। কাউকে কৈফিয়ত দিতে হয় না।

আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী থেকে আরো পড়ুন

বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জ্বালানি তেল মজুত আছে। ভেনেজুয়েলায়, যা ৩০০ বিলিয়ন ব্যারেলের বেশি। এরপর সৌদি আরব ২৯৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন ব্যারেল। বেশি তেল মজুত থাকা সত্ত্বেও ভেনেজুয়েলা ধনী দেশ নয়। পশ্চিমাদের অবরােধের কারণে দেশটির তেল উত্তোলনব্যবস্থা আধুনিক নয়। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের জো বাইডেন প্রশাসন অবরােধ শিথিল করার কথা ভাবছে।

কম তেল উৎপাদনের সিদ্ধান্ত

রাশিয়াকে সঙ্গে রেখে ওপেকভুক্ত দেশগুলাে ৫ অক্টোবর ২০২২ ভিয়েনায় জরুরি বৈঠক করে। ২০২০ সালের শুরুতে করােনা অতিমারির পর এটা ছিল সদস্যদেশগুলাের প্রথম সরাসরি বৈঠক। বৈঠকে নেতারা ৩০ মিনিটেই সিদ্ধান্তে উপনীত হন— এখন যে হারে তারা তেল উত্তোলন করছেন, তা থেকে প্রতিদিন দুই মিলিয়ন ব্যারেল কম উত্তোলন করবেন, যা কার্যকর হবে নভেম্বরের শুরু থেকে।

বৈশ্বিক অর্থনীতি ও তেলের বাজারে একধরনের অনিশ্চয়তা চলছে। সেই জায়গায় বাজারে স্থিতিশীলতা আনতেই এমন সিদ্ধান্ত— উৎপাদনে কাটছাঁটের পর এমন কথা বলেছেন সৌদি আরবের জ্বালানিমন্ত্রী আবদুল আজিজ বিন সালমান। বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করলে এভাবে বলতে হবে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর জ্বালানি সরবরাহের বিরাট ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এতে বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নাজুক হয়ে পড়েছে, অর্থাৎ উৎপাদন কমে গেছে। বিশ্বজুড়ে মন্দার পূর্বাভাস। ওপেকভুক্ত দেশগুলাে ভাবছে, এই মন্দার বাজারে এত তেল উত্তোলন করে কী হবে? তার চেয়ে উৎপাদন একটু কমিয়ে বাজারে চাহিদা ধরে রাখা যাক। দামও ঠিকঠাক থাকুক। এ কারণেই এমন সিদ্ধান্ত।

কম তেল উৎপাদনের সিদ্ধান্তের প্রভাব

কম তেল উৎপাদনের ওপেকভুক্ত দেশগুলাের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরদিনই জ্বালানি তেলের দাম ১ দশমিক ৭ শতাংশ বেড়ে যায়। প্রতি ব্যারেল তেলের দাম হয় ৯৩ দশমিক ২৯ ডলার। ২০২২ সালের অক্টোবর মাসের শুরুতে যা ছিল প্রায় ৮৯ ডলার। উল্লেখ্য, ১ ব্যারেল সমান ১৫৯ লিটার।। বছরের শুরুতে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৭৯ ডলারের কাছাকাছি ছিল। ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযানের দুই সপ্তাহের মধ্যে গত মার্চে তা ১২৭ ডলারে পৌঁছায়, যা ছিল গত ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। পরে মন্দার সম্ভাব্য ঝুঁকিতে জ্বালানি তেলের দাম কমতে থাকে। এখন ওপেকের এই সিদ্ধান্তে দাম আবার ১০০ ডলারে পৌছে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।

ওপেকভুক্ত দেশগুলাে কত তেল উৎপাদন করে

ওপেকভুক্ত দেশগুলাে প্রতিদিন কত পরিমাণ জ্বালানি তেল উৎপাদন করে, তা দেখা যাক। এ বছরের আগস্টে প্রতিদিন তারা ২৯ দশমিক ৭ মিলিয়ন ব্যারেল তেল উৎপাদন করেছে। এর মধ্যে সৌদি আরব একাই করেছে ১০ দশমিক ৯ মিলিয়ন ব্যারেল। এরপর ইরাক ৪ দশমিক ৫ মিলিয়ন ব্যারেল। সংযুক্ত আরব আমিরাত ৩ দশমিক ২, কুয়েত ২ দশমিক ৮ ও ইরান ২ দশমিক ৬ মিলিয়ন ব্যারেল। বিশ্বের দৈনিক চাহিদার ৪০ শতাংশ জ্বালানি তেল উৎপাদন করে ওপেক প্লাসভুক্ত দেশগুলাে।

রাশিয়ার স্বার্থ

বলা হচ্ছে, ওপেকের এই সিদ্ধান্ত রাশিয়ার জন্য ইতিবাচক হয়েছে। রাশিয়া বর্তমানে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মূল্যছাড়ে চীন ও ভারতের কাছে তেল বিক্রি করছে। সে ক্ষেত্রে ব্যারেলপ্রতি মূল্য ১০০ ডলারের আশপাশে থাকলে মস্কোর জন্য সুবিধা। উৎপাদনগত পদ্ধতির জটিলতা, দুর্নীতি ইত্যাদি মিলিয়ে প্রতি ব্যারেল অপরিশােধিত তেল উৎপাদনে রাশিয়ার খরচ হয় ৪৫ ডলারের মতাে। অর্থাৎ তেলের দাম যদি ৬০-৭০ ডলারে চলে আসে, তাহলে এক-তৃতীয়াংশ ছাড় দিয়ে রাশিয়ার পক্ষে লাভ করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ তেলের সরবরাহ বাড়িয়ে এর মূল্য উল্লেখযােগ্যভাবে কমানাে গেলে সেটা রাশিয়ার ওপর প্রচণ্ড অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করত। ওপেকের মাধ্যমে সেটাই চেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরােপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। কিন্তু সৌদি আরবের নেতৃত্বে ওপেকভুক্ত দেশগুলাে সে কথা শােনেনি।

ক্ষুব্ধ যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ

ওপেকের এ সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরােপ উভয়কে বেজায় ক্ষুব্ধ করেছে। এ রকম কিছু একটা অনুমান করতে পেরেছিল তারা। তাই আগেই জুলাইয়ের শেষে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মােহাম্মদ বিন সালমানকে, যিনি ‘এমবিএস’ নামে পরিচিত, প্যারিসে এলিসি প্রাসাদে সাড়ম্বরে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখো। একই অনুরােধ নিয়ে ২৪ সেপ্টেম্বর রিয়াদে গিয়েছিলেন জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলঞ্জ। কিন্তু সব চেষ্টাই জলে গেছে। ইউরােপে শীতকাল আসছে। এ সময়ে এমনিতেই গ্যাসের চাহিদা বেশি থাকে।

মূলত রাশিয়ার গ্যাসের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল ছিল পশ্চিম ইউরােপের দেশগুলাে। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রাশিয়া থেকে ইউরােপে গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। কারণ, রাশিয়ার ওপরই অবরােধ দিয়ে রেখেছে। ইউরােপের দেশগুলাে। এমনিতেই ইউরােপে উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলছে। এখন জ্বালানি তেলের দাম আরেক দফা বাড়লে জিনিসপত্রের দামও বাড়বে। সব মিলিয়ে কঠিন সংকটে পড়বে ইউরােপ।

জ্বালানি তেলের উৎপাদন কমানােয় বেশি খেপেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। প্রথমত, দেশটির মধ্যবর্তী নির্বাচন সামনে। নির্বাচনের আগে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে তারা। তেলের দাম বাড়লে সেই চেষ্টা হুমকিতে পড়তে পারে। বাইডেন মনে করছেন, তাঁকে বিপদে ফেলার জন্যই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সৌদি আরবকে চড়া মূল্য দিতে হবে বলেও বাইডেন হুমকি দিয়ে রেখেছেন। এ হুমকির মধ্যে রাজনীতি আছে।

সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মােহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে বাইডেনের আগে থেকে শীতল সম্পর্ক। তুরস্কে সৌদি কনস্যুলেটে সাংবাদিক জামাল খাসােগি নিহত হলে তখনকার ডেমােক্র্যাট নেতা বাইডেন এর তীব্র সমালােচনা করেছিলেন। আর তখনকার প্রেসিডেন্ট ডােনাল্ড ট্রাম্প তেমন কোনাে সমালােচনাই করেননি। কারণ, ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনারের সঙ্গে সালমানের দহরমমহরম সম্পর্ক ছিল।

তারপরও প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরে এ বছর জুলাই মাসে বাইডেন সৌদি আরব সফর করেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল, সালমানের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও সৌদির তেল উৎপাদন বাড়ানাের অনুরােধ করা। পশ্চিমা অনেক বিশ্লেষক ওপেক প্লাস জোটের সিদ্ধান্তকে পশ্চিমাদের প্রতি, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি চপেটাঘাত হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। কংগ্রেসের বেশ কজন প্রভাবশালী ডেমােক্র্যাট সদস্য সৌদি আরবকে লক্ষ্য করে খােলাখুলি হুমকির সুরে কথা বলছেন।

প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য টম মালিনােস্কি ও শন ক্যাসটেন বলেছেন, সৌদি আরব ‘শত্রুর মতাে আচরণ করেছে। তারা এমন একটি বিল উত্থাপনেরও হুমকি দিয়েছেন, যাতে প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে সৌদি আরব থেকে তিন হাজার মার্কিন সৈন্য এবং ক্ষেপণাস্ত্র-প্রতিরােধব্যবস্থা প্রত্যাহার করতে হবে। বাস্তবিক অর্থেই বাইডেন প্রশাসন যদি সৌদির বিরুদ্ধে কঠিন কোনাে ব্যবস্থা নেয়, তা ওয়াশিংটনের জন্য ‘বুমেরাং হতে পারে। ওয়াশিংটন যদি রিয়াদের কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করে দেয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে বড় অস্ত্র বিক্রেতা দেশ। দেশটির অস্ত্রের বড় ক্রেতা সৌদি আরব।।

সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

তেল উৎপাদন কমিয়ে দেওয়ার ওপেকের এ সিদ্ধান্তের ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরােপের যা-ই হােক, বাংলাদেশের মতাে দেশগুলাের সংকট আরও বাড়বে। একদিকে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, অন্যদিকে ডলারের তুলনায় স্থানীয় মুদ্রার পতনে এ দেশগুলাে এমনিতেই সংকটে রয়েছে। বেশি দামের ডলার দিয়ে জ্বালানি তেল কিনে রিজার্ভের অবস্থা ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে বেশির ভাগ দেশ। এ প্রবণতা বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে। সামনে অপেক্ষা করছে অনিশ্চিত এক ভবিষ্যৎ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Accept !) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Accept !