এ বছর কালজয়ী কথাসাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ জন্মশতবর্ষ। ২০২২ সালের ১৫ আগস্ট জন্মের ১০০ বছর পূর্ণ করেছেন তিনি। ১৯২২ সালের ১৫ আগস্ট সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ চট্টগ্রামের ষােলশহরে জন্মগ্রহণ করেন। সরকারি চাকরি করতেন বাবা সৈয়দ আহমদউল্লাহ। ফলে বদলির সূত্রে পুত্র ওয়ালীর শিক্ষাজীবন কেটেছিল সারা বাংলার প্রায় চারদিকজুড়ে—ময়মনসিংহ, ঢাকা, ফেনী, হুগলী, চুঁচুড়া, কৃষ্ণনগর, কুড়িগ্রাম, সাতক্ষীরা, মুন্সিগঞ্জ ও মানিকগঞ্জে।
শিক্ষাজীবন
১৯৩৯ সালে কুড়িগ্রাম হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন তিনি। এরপর ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। কলেজের প্রথম বর্ষে থাকতেই ঢাকা কলেজের ম্যাগাজিনে তাঁর প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়—‘সীমাহীন এক নিমেষে। ১৯৪১ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন ওয়ালীউল্লাহ। বাবার চাকরির সুবাদে কিছুদিন পর তাঁকে ময়মনসিংহ চলে যেতে হয়েছিল। সেখানে আনন্দ মােহন কলেজ থেকে ডিষ্টিংকশনসহ বিএ (১৯৪৩) পাস করেন তিনি। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হলেও শেষ পর্যন্ত তা শেষ করেননি।
কর্মজীবন
১৯৪৫ সালে দৈনিক স্টেটসম্যান’-এর সাব-এডিটর পদে যােগদানের মধ্য দিয়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র কর্মজীবনের শুরু। এই বছরেই লেখক সঞ্জয় ভট্টাচার্য ও সুধীন্দ্রনাথ দত্তদের সঙ্গে পরিচয় ঘটে তার। সওগাত’, ‘অরণি’, ‘পূর্বাশা’, ‘মােহাম্মদী’, ‘চতুরঙ্গ’, ‘বুলবুলসহ তৎকালীন বিখ্যাত ও প্রচারসফল পত্রপত্রিকায় তাঁর লেখা : প্রকাশ পেতে থাকে। প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘নয়নচারা’র প্রকাশক সঞ্জয় ভট্টাচার্য। ১৯৪৭ সালে রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রের সহকারী বার্তা সম্পাদক হয়ে তিনি ঢাকায় আসেন এবং ১৯৫১ সালে যুক্ত হন কূটনৈতিক পেশায়। কর্মজীবনের বড় একটা সময় তিনি বিদেশে কাটান।
বিয়ে
১৯৫৫ সালে ফরাসি নাগরিক অ্যান মেরির সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ওয়ালীউল্লাহ্। ২০১২ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত হয়েছিল অ্যান মারির ওয়ালীস্মৃতিচারণামূলক ছােট্ট বই ‘আমার স্বামী ওয়ালী’।
মুক্তিযুদ্ধে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচার চালান এবং বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে ফরাসি একাডেমির সদস্য পিয়ের এমানুয়েল, আঁদ্রে মারলাে প্রমুখ বুদ্ধিজীবীর সহযােগিতায় বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বজনমত গড়ে তােলার চেষ্টা করেন।
মৃত্যু
১৯৭১ সালের ১০ অক্টোবর প্যারিসে তাঁর মৃত্যু হয় এবং প্যারিসের উপকণ্ঠে মর্দো-স্যুর বেলভু-তে তিনি সমাহিত হন।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ও লালসালু
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ পেশায় কূটনীতিক হলেও একাধারে তিনি ছিলেন সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর। কল্লোল যুগের ধারাবাহিকতায় তাঁর আবির্ভাব হলেও তিনি ইউরােপীয় আধুনিকতায় পরিশ্রুত নতুন সাহিত্যবলয়ের ভিত্তি তৈরি করেন। লালসালু সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ রচিত একটি জনপ্রিয় বাংলা উপন্যাস।
১৯৪৮ সালে রচিত উপন্যাসটিতে ধর্মপ্রবণ মুসলিম সমাজে এক কল্পিত মাজারকে পুঁজি করে কীভাবে গ্রামবাংলার এক চতুর ধর্মব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠা পায় এবং শেষে তারই কিশােরী স্ত্রী জমিলা কীভাবে তাকে আশঙ্কাগ্রস্ত করে তােলে, তারই আলেখ্য চিত্রিত হয়েছে। স্বল্প পরিসরে গ্রামীণ পটভূমিকায় লেখক ধর্মান্ধতার স্বরূপ উন্মােচন করতে সক্ষম হন।
১৯৬০ সালে পাকিস্তান লেখক সংঘ কর্তৃক করাচি থেকে উপন্যাসটির উর্দু অনুবাদ, একই বছর প্যারিস থেকে ফরাসি ভাষায় অনুবাদ (‘L arbre sans raciness’ অর্থাৎ শিকড়বিহীন গাছ) এবং ১৯৬৭ সালে লন্ডন থেকে ইংরেজি অনুবাদ ‘Tree with out Roots’ প্রকাশিত হয়। পরে চেক ও জার্মান ভাষাতেও এটির অনুবাদ হয়। উপন্যাসটি অবলম্বনে তানভীর মােকাম্মেলের পরিচালনায় ২০০১ সালে ঢাকায় একটি চলচ্চিত্রও
নির্মিত হয়েছে।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ অন্যান্য সৃষ্টিকর্ম ও স্বীকৃতি
উপন্যাস :
লালসালু (১৯৪৮), চাঁদের অমাবস্যা (১৯৬৪), কাঁদো নদী কাঁদো (১৯৬৮), The Ugly Asian (১৯৬৩)।
গল্পগ্রন্থ :
নয়নচারা (১৯৫১), দুই তীর ও অন্যান্য গল্প (১৯৬৫), গল্পসমগ্র (১৯৭২)।
নাটক :
বহিপীর (১৯৬০), তরঙ্গভঙ্গ (১৯৬৪), সুড়ঙ্গ (১৯৬৪), উজানে মৃত্যু (১৯৬৬)। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র দুটি উপন্যাস ‘চাঁদের অমাবস্যা ও ‘কাঁদো নদী কাঁদো বাংলা সাহিত্যে দুটি ব্যতিক্রমধর্মী সৃষ্টি। তিনি এ দুটি উপন্যাসে ‘চেতনাপ্রবাহ রীতি ও ‘অস্তিত্ববাদ’-এর ধারণাকে অসাধারণ রূপক ও শিল্পকুশলতায় মূর্ত করে তুলেছেন। ছােটগল্প ও নাটকেও তিনি সমাজের কুসংস্কার, ধর্মীয় ভণ্ডামি, মানসিক ও চারিত্রিক স্থলন ইত্যাদিকে প্রতিভাসিত করেছেন।
পুরস্কার :
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ দেশ-বিদেশের নানা সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৬১ সালে লালসালু উপন্যাসের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হন। বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ১৯৮৩ সালে একুশে পদক’ (মরণােত্তর) প্রদান করে।