স্বাধীনতার পরের বছর ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে ৩৪ কোটি ৮৪ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিল বাংলাদেশ। তার মধ্যে ৯০ শতাংশ বা ৩১ কোটি ৩১ লাখ ডলার ছিল পাট ও পাটজাত পণ্য। পাটের পর প্রধান রপ্তানি পণ্যের মধ্যে ছিল চামড়া ও চা। মােট রপ্তানিতে পণ্য দুটির অবদান ছিল ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ। তার বাইরে কৃষিপণ্য, হিমায়িত চিংড়ি, মাছ, রাসায়নিক, কাগজ, হস্তশিল্পসহ কিছু পণ্য রপ্তানি হতাে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরাের (ইপিবি) পুরােনাে দলিলে এ তথ্য মিলেছে। অবশ্য পাঁচ দশকের ব্যবধানে দেশের পণ্য রপ্তানির চেহারাই বদলে গেছে। বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছর পণ্য রপ্তানি ৫ হাজার ২০৮ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। তার মধ্যে প্রায় ৮২ শতাংশ তৈরি পােশাক। অথচ স্বাধীনতার পর পণ্য রপ্তানির তালিকায় তৈরি পােশাকের কোনাে নাম-নিশানা ছিল না। ১৯৭৬-৭৭ অর্থবছর থেকে পণ্য রপ্তানির তালিকায় পােশাক যুক্ত হয়। তারপর থেকে ধীরে ধীরে পাট ও পাটজাত পণ্যের আধিপত্য কমতে থাকে। এ প্রসঙ্গে পরে আসছি।
স্বাধীনতার পর মূলত প্রাথমিক পণ্য ও উৎপাদন খাতের হিস্যা ছিল প্রায় কাছাকাছি। আর বর্তমানে পণ্য রপ্তানির সিংহভাগই উৎপাদন খাতের, প্রায় ৯৬ শতাংশ। তবে প্রথম তিন দশকে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় কিছুটা স্লথ গতিতেই এগােয়। ১৯৯৯-২০০০ সালে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি দাঁড়ায় ৫৭৫ কোটি ডলারে। তার মানে, স্বাধীনতার পর তত দিনে রপ্তানি বেড়েছে ১৬ গুণ।
তখন পােশাক ছাড়া পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, হিমায়িত চিংড়ি, কৃষিপ্রক্রিয়াজাত পণ্য, রাসায়নিক, প্রকৌশল পণ্য, বাইসাইকেল ইত্যাদি পণ্য রপ্তানি হয়। চলতি শতাব্দীর দুই দশকে, পরিষ্কার করে বললে গত ২২ বছরে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি ৪ হাজার ৬৩৩ কোটি ডলার বেড়ে ৫২ বিলিয়ন (৫ হাজার ২০০ কোটি) ডলারের মাইলফলকে পৌঁছেছে। তার মানে, স্বাধীনতার পর গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশের রপ্তানি ১৪৯ শতাংশ বেড়েছে।
তৈরি পােশাক ছাড়া অন্যান্য খাতের রপ্তানি ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। সেগুলাে হলাে পাট ও পাটজাত পণ্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, হােম টেক্সটাইল, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। আগেই বলেছি, স্বাধীনতার পর পণ্য রপ্তানির তালিকায়। তৈরি পােশাক ছিল না। তবে গেঞ্জি রপ্তানি হতাে, তা-ও সামান্য। সেই পােশাক খাতের রপ্তানি গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ৪ হাজার ২৬১ কোটি ডলার।
পাটকে হটিয়ে নব্বইয়ের দশকে রপ্তানিতে শীর্ষ স্থান দখল করেছে তৈরি পােশাক। প্রায় ৪০ লাখ গ্রামীণ নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান, নারীর ক্ষমতায়ন, সহযােগী শিল্পের বিকাশসহ নানাভাবে দেশের অর্থনীতিতে অনেক অবদান রাখছে তৈরি পােশাকশিল্প। চীনের পর একক দেশ হিসেবে পােশাক রপ্তানিতে দ্বিতীয় শীর্ষ স্থানে।
পৌঁছায় বাংলাদেশ। যদিও করােনাকালে ভিয়েতনামের কাছে দ্বিতীয় স্থান হারায় বাংলাদেশ। পরিবেশবান্ধব পােশাক কারখানার সংখ্যার দিকেও সবার ওপরে বাংলাদেশ। বর্তমানে পরিবেশবান্ধব কারখানার সংখ্যা ১৬৫ (গত ১৬ জুলাই পর্যন্ত)। বেসরকারি খাতে ১৯৭৮ সালে রিয়াজ গার্মেন্টসের মাধ্যমে পােশাক রপ্তানির যাত্রা শুরু। প্রতিষ্ঠানটি ১০ হাজার পিস শার্ট রপ্তানি করেছিল ফ্রান্সে। সেই চালানে ১ লাখ ৩০ হাজার ফ্র বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে রিয়াজ উদ্দিনের হাতে গড়া রিয়াজ গার্মেন্টস। সেই থেকে শুরু। তারপর আসে দেশ গার্মেন্টস।
সরকারি চাকরি ছেড়ে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে নুরুল কাদের খান প্রতিষ্ঠা করেন দেশ গার্মেন্টস। প্রতিষ্ঠানটি ১৯৭৯ সালে পােশাক রপ্তানি শুরু করে। কাজ শেখানাের জন্য দেশ গার্মেন্টসের ১৩০ জনকে সে সময় কোরিয়ায় পাঠিয়েছিলেন নূরুল কাদের। তাঁদের অনেকেই পরে পােশাক কারখানার মালিক হন। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে ওপেক্স নামে পােশাক কারখানা প্রতিষ্ঠান করেন আনিসুর রহমান সিনহা। দ্রুতই প্রতিষ্ঠানটির কলেবর বাড়তে থাকে। বছর দশকের মধ্যেই ৪৫ হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান করতে সক্ষম হয়। ওপেক্সের কাছাকাছি সময়ে আনিসুল হক, এ কে আজাদ, মােস্তফা গােলাম কুদুস, কুতুবউদ্দিন। আহমেদসহ আরও অনেকে পােশাকের ব্যবসায় আসেন।
সে সময়কার অনেক প্রতিষ্ঠানই এখন পােশাক খাতে নেতৃত্ব দিচ্ছে। তৈরি পােশাকের পাশাপাশি দেশে অন্যান্য খাতেও ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ করেছে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই। সস্তা শ্রম, সরকারের নীতিসহায়তা আর উদ্যোক্তাদের নিরলস পরিশ্রমের কারণে পােশাকশিল্পের কলেবর দ্রুতই বাড়ে। তাই ২০০৫ সালে কোটাব্যবস্থা উঠে গেলেও খাতটির অগ্রযাত্রা থেমে থাকেনি বাংলাদেশ।
তখন ইউরােপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) বিশেষ অগ্রাধিকারমূলক বাজারসুবিধা বা জিএসপি কাজে লাগিয়ে এগােতে থাকে খাতটি। কানাডাসহ কয়েকটি দেশে শুল্কমুক্ত সুবিধা পােশাক রপ্তানি প্রবৃদ্ধিতে ভালােভাবে সহায়তা করে। কোটাব্যবস্থা উঠে যাওয়ার পােশাকের খাতে বড় ধাক্কাটি খায় ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর।
সেদিন তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক শ্রমিক মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। এটি সামলে ওঠার আগেই মালিকদের অবহেলায় ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারে ভবনধসের ঘটনা ঘটে, যা দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিল্প দুর্ঘটনা। রানা প্লাজা ধসে ১ হাজার ১৩৮ শ্রমিক মারা যান।
পাঁচ মাসের ব্যবধানে বড় দুটি ঘটনায় অস্তিত্ব রক্ষার চ্যালেঞ্জে পড়ে তৈরি পােশাক খাত। দেশে দেশে বাংলাদেশি পােশাক বর্জনের ডাক দেয় শ্রম অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলাে। তীব্র সমালােচনার মুখে বিদেশি ক্রেতা ও শ্রম সংস্থার উদ্যোগে কর্মপরিবেশ উন্নয়নে ঝাঁপিয়ে পড়েন দেশের উদ্যোক্তারা।
বিপুল অর্থ বিনিয়ােগ করে কারখানার কাঠামােগত, বৈদ্যুতিক ও অগ্নিসংক্রান্ত ত্রুটি সংস্কার করে বিশ্বে ইতিবাচক বার্তা দিতে সক্ষম হােন তারা। তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ড ও রানা প্লাজা ধসের পর। ভালােভাবে ঘুরে দাঁড়ায় পােশাক খাত। বিষয়টি বােঝার জন্য একটি পরিসংখ্যানই যথেষ্ট। ২০১০-১১ অর্থবছরে পােশাক রপ্তানি ছিল ১ হাজার ৭৯১ কোটি ডলারের। পরের ৯ বছরে সেই রপ্তানি দ্বিগুণ বেড়েছে। তবে করােনাকালে নতুন করে সংকটে পড়েছে খাতটি।
যদিও দ্রুতই আবার পােশাক রপ্তানি ঘুরে দাঁড়ায়। চলতি বছর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে নতুন করে সংকটের আশঙ্কা করছেন উদ্যোক্তারা। ইউরােপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলাে সারা বছর যে পরিমাণ টি-শার্ট বা গেঞ্জি কেনে, তার প্রায় ৪০ শতাংশই বাংলাদেশি পােশাক কারখানা সরবরাহ করে। কেবল টি-শার্ট নয়, ট্রাউজার, শর্টস প্যান্ট ও পুরুষ বা বাচ্চাদের শার্টস রপ্তানিতে ইইউতে সবার ওপরে বাংলাদেশ। এ ছাড়া ডেনিম রপ্তানি ইইউর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রেও শীর্ষ স্থানে রয়েছেন বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা।
স্বাধীনতার আগে থেকেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) থেকে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হতাে। ১৯৭২ সালে পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি ছিল; ৩১ কোটি ৩১ লাখ ডলার, যা মােট রপ্তানির ৮৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ। ১৯৮৫-৮৬ অর্থবছরে এই খাতের রপ্তানি; ছিল ৪১ কোটি ডলার, যা মােট রপ্তানির ৫০ দশিমক ৯১ শতাংশ। বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত খাতের রপ্তানি বেড়ে হয়েছে ১১৩ কোটি ডলার। তার মানে, গত পাঁচ দশকে রপ্তানি বেড়েছে মাত্র ৩ দশমিক ৬০ গুণ। মােট রপ্তানির মাত্র ২দশমিক ১৭ শতাংশ হিসাব নিয়ে বর্তমানে পঞ্চম শীর্ষ রপ্তানি খাত হিসেবে বর্তমানে টিকে আছে পাট ও পাটজাত পণ্য।
পণ্য রপ্তানির দৌড়ে পাট ও পাটজাত পণ্য পিছিয়ে ; পড়েছে। তৈরি পােশাকের পর বর্তমানে সর্বোচ্চ পণ্য রপ্তানি হােম টেক্সটাইলে, ১৬২ কোটি ডলার। তৃতীয় সর্বোচ্চ ১২৫ কোটি ডলারের রপ্তানি চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে এসেছে। চতুর্থ ও পঞ্চম সর্বোচ্চ রপ্তানি আয়ের খাত হচ্ছে যথাক্রমে কৃষিপ্রক্রিয়াজাত পণ্য এবং পাট ও পাটজাত পণ্য। কৃষিপ্রক্রিয়াজাত পণ্যে ১১৬ কোটি এবং পাট ও পাটজাত পণ্যে ১১৩ কোটি ডলারের রপ্তানি আয় হয়েছে।
ইপিবির তথ্যানুযায়ী, মােট পণ্য রপ্তানিতে তৈরি পােশাক, হােম টেক্সটাইল, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পাট ও ; পাটজাত পণ্য এবং কৃষিপ্রক্রিয়াজাত পণ্য—এই পাঁচ খাতের অবদান ৯১ দশমিক ৭২ শতাংশ। তার মানে, পণ্য রপ্তানি বাড়লেও গুটিকয় পণ্যের ওপর অতিনির্ভরতার ‘ ব্যাপারটি এখনাে।
১৯৭২-৭৩ অর্থবছর মােট রপ্তানি ৩৪.৩১ কোটি ডলার | ২০২১-২২ অর্থবছর মােট রপ্তানি ৫,২০৮ কোটি ডলার | ||
রপ্তানির শীর্ষ খাত | রপ্তানির শীর্ষ খাত | ||
পাট ও পাটজাত পণ্য | ৩১.৩১ কোটি ডলার | তৈরি পােশাক | ৪,২৬১ কোটি ডলার |
কোটি ডলার চামড়া | ১.৬১ কোটি ডলার | হােম টেক্সটাইল | ১৬২ কোটি ডলার |
চা | ০.৯৬ কোটি ডলার | চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য | ১২৫ কোটি ডলার |
হিমায়িত খাদ্য | ০.৩০ কোটি ডলার | কৃষিপ্রক্রিয়াজাত পণ্য | ১১৬ কোটি ডলার |
কৃষিপণ্য | ০.০৭ কোটি ডলার | পাট ও পাটজাত পণ্য | ১১২ কোটি ডলার |