১৯৪৯ সালে চীনে কমিউনিস্টরা ক্ষমতা দখলের পর তাইওয়ান দেশটি মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরপর নিজস্ব সরকার ব্যবস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হয় তাইওয়ান। চীন যদিও তাইওয়ানকে বরাবরই নিজেদের একটি প্রদেশ বলে মনে করে। ২ আগস্ট ২০২২ তাইওয়ান সফরে যান মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষের স্পিকার ন্যান্সি পেলােসি। এরপরই চীন-তাইওয়ান উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
চীন তাইওয়ান ইতিহাস
২৩৯ খ্রিষ্টপূর্বের চীনা একটি নথিতে প্রথমবারের মতাে দ্বীপটির নাম দেখা যায়। সেই সময় একজন ম্রাট, এ অঞ্চলটি আবিষ্কারের জন্য একটি অভিযাত্রী বাহিনী পাঠান। আর এ নথিকে চীন তার আঞ্চলিক দাবির সমর্থনে ব্যবহার করে। ১৬২৪-১৬৬২ সাল পর্যন্ত উপনিবেশ হিসেবে ডাচ শাসনের অধীনে ছিল তাইওয়ান। ১৭ শতকে প্রথমবারের মতাে তাইওয়ানের পুরােপুরি নিয়ন্ত্রণ নেয় চীন।
চীনের কুইং রাজবংশ ১৬৮৩-১৮৯৫ সাল পর্যন্ত তাইওয়ান শাসন করে। তাইওয়ানের জনগােষ্ঠীর বিশাল অংশ মূল ভূখণ্ড চীন থেকে পর্যায়ক্রমে আগত। জনসংখ্যার অতিক্ষুদ্র অংশ আদিবাসী। চীনের বিভিন্ন অঞ্চলের অস্থিতিশীলতা ও দুর্দশা থেকে পালিয়ে তাইওয়ানে আসেন তারা। তাদের বেশিরভাগই ছিলেন ফুজিয়ান প্রদেশের হােকলাে চাইনিজ অথবা গুয়াংডং প্রদেশের হাক্কা চাইনিজ জনগােষ্ঠীর। আর তাদের বংশধররাই এখন পর্যন্ত এই দ্বীপের বৃহত্তম জনগােষ্ঠী।
২৫ জুলাই ১৮৯৪-১৭ এপ্রিল ১৮৯৫ প্রথম চীন-জাপান যুদ্ধে জাপান কুইং রাজবংশের কাছ থেকে তাইওয়ান দখল করে নেয়। ১০ অক্টোবর ১৯১১-১২ ফেব্রুয়ারি ১৯১২ সান ইয়াত সেনের নেতৃত্বে চীন বিপ্লব বা সিনহাই বিপ্লবের মাধ্যমে কুইং রাজবংশের পতন ঘটে। এই বিপ্লবের মাধ্যমে চীনে ২,০০০ বছরের রাজতন্ত্রের অবসান হয়। এরপর চীন প্রজাতন্ত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং নামকরণ করা হয় Republic of China বা ROC।
আরো পড়ুন : চীনের হংকং শাসনের ২৫ বছর পূর্তি
১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করলে চীন তাইওয়ানকে নিজেদের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে আবারও একীভূত করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় কোয়ালিশন সরকার গঠনের প্রস্তাব ব্যর্থ হলে চীনে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৪৯ সালে জাতীয়তাবাদী নেতা চিয়াং কাই শেকের কাছ থেকে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মাও সে তুং রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নেন।
১ অক্টোবর ১৯৪৯ তার নেতৃত্বে বিপ্লবী চীনা মুক্তিফৌজ সমগ্র চীনকে নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসে। মাও সে তুং তিন লাখ জনতার বিশাল সমাবেশে তিয়েনআনমেন স্কয়ার মঞ্চ হতে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার ঘােষণা দেন। অন্যদিকে, চিয়াং কাই শেক সদলবলে চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে পালিয়ে ফরমােজা (বর্তমানে তাইওয়ান) দ্বীপে আশ্রয় নেন। ফরমােজা নামটা জাপানি শব্দ।
যুক্তরাষ্ট্র-চীন-তাইওয়ান সম্পর্ক
১ অক্টোবর ১৯৪৯ মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর মূল ভূমিতে ক্ষমতায় আসে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি। তখন চীন প্রজাতন্ত্র (ROC) নামের পরিবর্তে দেশটির – নাম রাখা হয় গণপ্রজাতন্ত্রী চীন (PRC)। কমিউনিস্ট পার্টি অখণ্ড চীনে PRC’র সার্বভৌমত্ব দাবি করে। অন্যদিকে জাতীয়তাবাদী নেতা চিয়াং কাই শেকের নেতৃত্বে তাইওয়ানে আরেকটি সরকার গঠিত হয়। বিপ্লবের পর গঠিত, গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে যুক্তরাষ্ট্র।
১৯৫০ সালে কোরীয় যুদ্ধের সময় তাইওয়ান। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রে পরিণত হয়। ২ ডিসেম্বর ১৯৫৪ যুদ্ধ শেষ হলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আইজেন হাওয়ার তাইওয়ানের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি করেন। জবাবে চীন তাইওয়ানের ভূখণ্ডে হামলা করে। এবং দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে তাইওয়ানের নিয়ন্ত্রণাধীন বেশ কয়েকটি ছােট ছােট দ্বীপ দখল করে নেয়।
১৯৫৮ সালে তাইওয়ান-চীন দ্বিতীয় দফা সংকটে পতিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তায় তাইওয়ানও চীনা আক্রমণের জবাব দেয়। এই যুদ্ধে চীন কোনাে ভূখণ্ড। নিয়ন্ত্রণে নিতে পারেনি। ১৮-১৯ জুন ১৯৬০ প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডােয়াইট ডি. আইজেনহাওয়ার তাইওয়ান সফর করেন।
২৫ অক্টোবর ১৯৭১ জাতিসংঘ ROC-কে বাদ দিয়ে PRC কে স্বীকৃতি দেয়। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের চীন সফরের। মধ্য দিয়ে কয়েক দশকের শত্রুতার অবসান ঘটে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও চীনের প্রেসিডেন্ট মাও সে তুংয়ের মধ্যকার ঐতিহাসিক করমর্দন সেসময় স্নায়ুযুদ্ধের জ্যামিতি পাল্টে দেয়। স্বাভাবিক হয় দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক।
আরো পড়ুন : বাংলাদেশ এক চীন নীতিতে অটল
২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ দুই দেশ সাংহাই ইশতেহারে। স্বাক্ষর করে। ১৯৭৮ সালে চীন তার অর্থনীতি উন্মুক্ত করতে শুরু করে। বাণিজ্যিক সুযােগ এবং সম্পর্কোন্নয়নের প্রয়ােজনীয়তা স্বীকার করে যুক্তরাষ্ট্র ১ জানুয়ারি ১৯৭৯ তাইওয়ানের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পর্কচ্যুত করে চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। একই সাথে এক চীন নীতি মেনে নেয়। কিন্তু, তাইওয়ানের সঙ্গে সামরিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক বহাল রাখে।
চীনের তৎকালীন নেতা দেং জিয়াওপিং সে সময় চীন তাইওয়ানের জন্য এক দেশ, দুই নীতি’ এবং বল প্রয়ােগের পরিবর্তে শান্তিপূর্ণ একীভূতকরণের প্রস্তাব দেন। তবে ১৯৮২ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রােনাল্ড রিগ্যান যুক্তরাষ্ট্রের ‘তাইওয়ান সম্পর্ক আইন পরিবর্তন না করার অঙ্গীকারসহ তাইওয়ানকে ছয়টি আশ্বাস (Six Assurances) দেন।
১৯৮৭ সালের শেষে তাইওয়ানবাসীরা প্রথমবারের মতাে চীনের মূল ভূখণ্ডে যাওয়ার অনুমতি পায়। ১৯৯৩ সালে। সিঙ্গাপুরে প্রথম সরাসরি আলােচনা বসে চীন ও তাইওয়ান। ১৯৯৫ সালে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন তাইওয়ানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট লি তেং-হুইকে যুক্তরাষ্ট্র সফরের অনুমােদন দিলে চীন ক্ষুব্ধ হয়। এই সফর চীন-তাইওয়ান যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক আরও জটিল করে তােলে। এই সফরই তৃতীয় চীন-তাইওয়ান সংকট উসকে দেয়।
২১ জুলাই ১৯৯৫ চীন তাইওয়ানের মূল ভূখণ্ডের নিকটবর্তী জলসীমায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করে। জবাবে প্রতিশ্রুতি অনুসারে তাইওয়ান প্রণালিতে যুদ্ধবিমান মােতায়েন করে যুক্তরাষ্ট্র। তবে অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই বিষয়টি মিটে যায়। ২৩ মার্চ ১৯৯৬ তাইওয়ানের প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন চীনকে আরও অসন্তুষ্ট করে। সে সময় চীন তাইওয়ানের কাছে সামরিক মহড়া চালায় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনা আগ্রাসন রােধ করতে যুদ্ধজাহাজ পাঠায়।
২০০৫ সালের মার্চে চীন নতুন আইন অনুমােদন করে। আইনে বলা হয় তাইওয়ান স্বাধীনতার ডাক দিলে শক্তি প্রয়ােগ করবে চীন। ২০০৮ সালে তাইওয়ান এবং চীনের মধ্যে পুনরায় উচ্চপর্যায়ের আলােচনা শুরু হয়। ১৬ জানুয়ারি ২০১৬ অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ঐতিহ্যগতভাবে স্বাধীনচেতা ডেমােক্র্যাটিক প্রগ্রেসিভ পার্টির সাই ইং-ওয়েন জয়লাভ করে। প্রেসিডেন্ট সাই সরকারও ‘এক চীন নীতিকে মেনে নেয়নি। ২ ডিসেম্বর ২০১৬ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডােনাল্ড ট্রাম্প যুগের পর যুগ অটুট থাকা মার্কিন প্রথা ভেঙে টেলিফোনে সরাসরি কথা বলেন সাই’র সঙ্গে।
এক চীন নীতি
তাইওয়ানকে ‘অখণ্ড’ চীনের অংশ মনে কার নীতিই এক চীন নীতি’। ১৯৭২ সালে চীনের নেতা মাও সে তুং এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের মধ্যে এক চীন নীতি’র প্রতি মার্কিন সমর্থনের ব্যাপারে ঐকমত্য হয়।
সাম্প্রতিক সংকট |
সূত্রপাত যেভাবে
২ আগস্ট ২০২২ মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষের প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলােসি চীনের নিয়মিত হুমকি ও সতর্কতা উপেক্ষা করে তাইওয়ান সফরে যান। তিনি স্বায়ত্তশাসিত দ্বীপটির প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি দেন। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচিত উচ্চপর্যায়ের কোনাে কর্মকর্তার ২৫ বছরে এই প্রথম তাইওয়ান সফর। এর আগে ২ এপ্রিল ১৯৯৭ রিপাবলিকান নিউ গিরিচ তাইওয়ানে যান। ১৪ আগস্ট ২০২২ মার্কিন আইন প্রণেতাদের একটি দল তাইওয়ান সফর করে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ব্যক্তির তাইওয়ান সফরকে কেন্দ্র করে চীনের পদক্ষেপ-
- সামরিক মহড়া : ৪ আগস্ট ২০২২ তাইওয়ানকে ঘিরে থাকা অঞ্চলগুলােতে চীন বিশাল সামরিক মহড়া শুরু করে। কিছু কিছু জায়গায় তাইওয়ানের উপকূল থেকে দূরত্ব ছিল মাত্র ২০ কিলােমিটার। তাইওয়ান উপত্যকায় সামরিক মহড়ায় দূরপাল্লার গােলাও ছােড়া হয়। এই উপত্যকা চীন থেকে তাইওয়ানকে বিচ্ছিন্ন করেছে। এরপর আরও কয়েক দফায় সামরিক মহড়া চালায় চীন। জবাবে তাইওয়ানও সামরিক মহড়া চালায়।
- বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা : ৩ আগস্ট ২০২২ তাইওয়ান থেকে ফল ও মাছ আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরােপ করে চীন। এর মধ্যে অতিরিক্ত কীটনাশকের উপস্থিতি পাওয়ায় লেবুজাতীয় কিছু ফলের আমদানি স্থগিত করে। পাশাপাশি প্যাকেটে করােনাভাইরাস পাওয়া গেছে, এমন ইঙ্গিত করে তাইওয়ান থেকে নির্দিষ্ট কিছু মাছ আমদানি নিষিদ্ধ করে। তবে তাইওয়ানের কৃষিপণ্যের ওপর এমন নিষেধাজ্ঞা এবারই প্রথম নয়, ২০২১ সালে চীন কীটপতঙ্গ পাওয়ার অভিযােগ তুলে আনারস আমদানি নিষিদ্ধ করে।
তাইওয়ান নিয়ে নতুন শ্বেতপত্র
১০ আগস্ট ২০২২ তাইওয়ান নিয়ে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করে Blot The Taiwan Question and China’s Reunification in the New Era শীর্ষক নতুন এ শ্বেতপত্রে তাইওয়ানে হংকংয়ের মতাে এক দেশ, দুই নীতি’ মডেল প্রস্তাব করে। তবে তাইওয়ানের ভিতরে তৃতীয় পক্ষের কোনাে ধরনের উস্কানি বা বিচ্ছিন্নতাবাদী আচরণ বরদাস্ত করবে না চীন। প্রয়ােজনে তাইওয়ান অধিগ্রহণ করার পরে সেখানে সামরিক বাহিনী পাঠাবে।
নতুন শ্বেতপত্র আগের শ্বেতপত্রগুলাের প্রতিশ্রুতির বিপরীত। এর আগে ৩১ আগস্ট ১৯৯৩ ও ২১ ফেব্রুয়ারি ২০০০ প্রকাশিত শ্বেতপত্রে চীন প্রতিশ্রুতি দেয় পুনরেকত্রীকরণের পর হংকংয়ের মতাে তাইওয়ানের ক্ষেত্রেও ‘এক দেশ, দুই নীতি মেনে চলবে। অর্থাৎ কোনাে দিন চীন তাইওয়ান দখল করলেও সেখানে স্বশাসিত সরকার থাকবে এবং চীনের কোনাে সামরিক বাহিনী অথবা প্রশাসনিক কর্মী তাইওয়ান ভূখণ্ডে প্রবেশ করবে না।
আরো পড়ুন : বাংলাদেশ-চীনের সমঝােতা স্মারক
চীনের বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল হওয়ার পর তাইওয়ানকে স্বায়ত্তশাসনের আশ্বাস দেওয়া হয় সেই শ্বেতপত্রে। ১১ আগস্ট ২০২২ তাইওয়ানের মেইনল্যান্ড অ্যাফেয়ার্স কাউন্সিল (MAC) শ্বেতপত্রে প্রস্তাবিত ‘এক দেশ, দুই নীতি’ মডেল প্রত্যাখ্যান করে। MAC চীন বিষয়ে তাইওয়ানের শীর্ষ নীতিনির্ধারক সংস্থা।
এক দেশ, দুই নীতি
‘এক দেশ, দুই নীতি’ (One country, two systems) চীনের একটি মৌলিক আইন। এ মডেল প্রয়ােগের মাধ্যমে চীনা শাসনের অধীনেই স্বায়ত্তশাসন লাভ করে হংকং ও ম্যাকাও। ১৯ ডিসেম্বর ১৯৮৪ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার এবং চীনা প্রধানমন্ত্রী ঝাও জিয়াং সিনাে-ব্রিটিশ যৌথ ঘােষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন। ঘােষণাপত্রের বিশেষ শর্তটি ছিল ১৯৯৭ সালের পর থেকে চীন হংকংকে নিয়ন্ত্রণ করবে এক দেশ, দুই নীতি অনুযায়ী।
পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা বিষয়াবলি ব্যতিরেকে হংকং পরবর্তী ৫০ বছর অর্থাৎ ২০৪৭ সাল পর্যন্ত উচ্চ পর্যায়ের স্বায়ত্তশাসন উপভােগ করবে। এরই ধারাবাহিকতায় ৪ এপ্রিল ১৯৯০ চীনের বিশেষ অঞ্চল হিসেবে হংকং এর জন্য মৌলিক আইন গৃহীত হয়।
১ জুলাই ১৯৯৭ হংকং এর মৌলিক আইনটি কার্যকর হয়। যার ফলে হংকং ব্রিটিশদের অধীনতা মুক্ত হয়ে চীনের বিশেষ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। আর এরই মাধ্যমে অভিনব ‘এক দেশ, দুই নীতি ব্যবস্থার যাত্রা শুরু হয়। মৌলিক আইন অনুযায়ী, শুধু একটি চীন থাকবে, কিন্তু স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা বজায় রাখতে পারবে।
যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ তাইওয়ান
যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তাইওয়ান ভূ-রাজনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চীনের সামরিক প্রভাব খর্বতে যুক্তরাষ্ট্র তাদের প্রভাব রাখতে চায় ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া থেকে রু করে জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়া পর্যন্ত। তাইওয়ান এর মাঝখানে এবং চীনের খুব কাছাকাছি। চীন-তাইওয়ান দখল করলে এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব খর্ব হয়ে যাবে।
১৯৭৯ সালে প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের সময় Taiwan Relations Act করা হয়। এর মাধ্যমে দেশটি তাইওয়ানকে সামরিক সহায়তা ছাড়াও অন্যান্য সহায়তা দেয়। স্বাধীন তাইওয়ানের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করে না এবং চীনের অংশ হিসেবেও মানতে চায় না। তবে স্বাধীন রাষ্ট্র বলে স্বীকৃত না হলেও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় তাইওয়ান যাতে সদস্যপদ লাভ করে সেজন্য যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন দেয়।
হুমকিতে বৈশ্বিক বাণিজ্য
ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে খাদ্যশস্য রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এবং রাশিয়ার তেলের ওপর পশ্চিমা বিশ্ব নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় বিশ্ব বাজার এখন অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। এর মধ্যে তাইওয়ান ও চীনের মধ্যকার সংঘাত আতঙ্ক আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। কারণ তাইওয়ানও এশিয়া তথা বিশ্বের জন্য অধিক গুরুত্বপূর্ণ। তাইওয়ানকে মাত্র ১৩টি দেশ স্বীকৃতি দিলেও পুরাে পৃথিবী এর ওপর নির্ভর করে।
তাইওয়ান সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে। বিশ্বে সেমিকন্ডাক্টরের যে বাজার তার ৬৪ শতাংশই তাইওয়ানের নিয়ন্ত্রণে। শুধু তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি (TSMC) বিশ্বের অর্ধেকের বেশি সেমিকন্ডাক্টর তৈরি করে। স্মার্টফোন থেকে শুরু করে যুদ্ধবিমান, সব জায়গায় দরকার পড়ে এই সেমিকন্ডাক্টর।
দেশটির রপ্তানি আয়ের ৪০% আসে সেমিকন্ডাক্টর থেকে এবং জিডিপিরও ১৫% নির্ভর করে এর ওপর। এই সেমিকন্ডাক্টরের কারণেই কৌশলগত দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিম ইউরােপের দেশগুলাের কাছে তাইওয়ান গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া প্লাস্টিক ও প্লাস্টিক সামগ্রী, অপটিক্যাল, চিকিৎসা যন্ত্রপাতি, যানবাহন, লােহা, ইস্পাত, জৈব রাসায়নিক, তেলসহ খনিজ জ্বালানি, তামা, মৎস্যজাত পণ্য, চা, মধু, প্রাকৃতিক বালু ও আনারসসহ আরও অনেক কিছু বিশ্বে রপ্তানি করে দেশটি।
এসব পণ্যের রপ্তানি বন্ধ হলে বিশ্ব অর্থনীতি বড় ধরনের ধাক্কা খাবে। আবার নিজেদের মােট রপ্তানির ৩০ ভাগই চীনে পাঠায় তাইওয়ান। তাই চীনের যেকোনাে নিষেধাজ্ঞাই বড় প্রভাব ফেলে দেশটির ওপর। ইতােমধ্যে তাইওয়ানগামী অনেক বিমানের ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। সমুদ্রপথেও জাহাজ চলাচল বন্ধ প্রায়।
তাইওয়ান প্রণালি |
প্রণালি (Strait) হলাে পানির একটি সরু পথ, যা দুটি বৃহত্তর জলরাশিকে সংযুক্ত করে। প্রণালির মাধ্যমে দুই বা ততােধিক ভূখণ্ড আলাদা হয়। তাইওয়ান প্রণালি চীন এবং তাইওয়ানকে পৃথককারী একটি অগভীর সামুদ্রিক প্রণালি। প্রণালিটি দক্ষিণ চীন সাগরকে পূর্ব চীন সাগরের সাথে সংযুক্ত করেছে। সবচেয়ে সংকীর্ণ অংশ প্রায় ১৩০ কিলােমিটার প্রশস্ত এবং সর্বোচ্চ ৭০ মিটার গভীর। এটি ফরমােজা (সুন্দর) প্রণালি নামেও পরিচিত।
প্রণালিটি দক্ষিণ চীন সাগরের সাথে যুক্ত। আর দক্ষিণ চীন সাগর প্রশান্ত মহাসাগর ও ভারত মহাসাগরকে সংযুক্ত করেছে, যা বিশ্বের সমুদ্রগামী জাহাজ চলাচলের ব্যস্ততম রুট। বিশ্ব অর্থনীতিতে এ প্রণালির গুরুত্ব অত্যধিক। চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানে উৎপাদিত পণ্য জাহাজে করে ইউরােপ ও বিশ্বের অন্যান্য বাজারে পরিবহনের প্রধান নৌপথ এই প্রণালি। সারা এ জাহাজ চলাচল করে তার প্রায় অর্ধেক এবং বড় বড় জাহাজগুলাের ৮৮% তাইওয়ান প্রণালি দিয়ে যাওয়া-আসা করে।
তাই বর্তমান বিশ্বের যেসব অঞ্চলকে সামরিক সংঘাতপ্রবণ এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তার মধ্যে এ সময়ের অন্যতম সামরিক উত্তেজনাপূর্ণ ‘হটস্পট’ অঞ্চল তাইওয়ান প্রণালি। তবে এ প্রণালির মালিকানা নিয়ে অন্তর্জাতিক বিতর্ক রয়েছে। চীন জলপথটিকে আন্তর্জাতিক জলসীমার পরিবর্তে ‘অভ্যন্তরীণ আঞ্চলিক জলসীমা’ হিসেবে বিবেচনা করে।
অর্থাৎ, চীন সরকার এ প্রণালিতে বিদেশি জাহাজের চলাচলের স্বাধীনতা অস্বীকার করে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্ররা এটিকে আন্তর্জাতিক জলসীমা বলে গণ্য করে এবং নিজেদের বাণিজ্যিক জাহাজ, যুদ্ধজাহাজ ও যুদ্ধবিমানের স্বাভাবিক চলাচল বৈধ মনে করে।