বর্তমান সরকার প্রথমবারের মতাে ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তােলার একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করে। একটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ভেতর দিয়ে ১৯৭১ সালে আমরা আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করেছি, ২০২১ সালে তার অর্ধশতাব্দী পূর্ণ হবে এবং সে কারণে এই সময়ের ভেতরে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে একটি বিশেষ জায়গায় নেওয়ার একটি স্বপ্ন আমাদের সবাইকে স্পর্শ করেছিল।
তাই ডিজিটাল বাংলাদেশ কথাটি শুধু একটি কথা হয়ে থাকেনি। এটাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্যে এই দেশের সরকার এবং সাধারণ মানুষ সবাই একটি বড় উদ্যোগ নিয়েছে।
প্রথমেই আমাদের জানা দরকার এনালগ ও ডিজিটাল কথাটি দিয়ে আমরা কী বােঝাই। পরিবর্তনশীল (বিচ্ছিন্ন) ডাটাকে যখন সংকেতের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয় তখন তাকে এনালগ সংকেত বলে। উদাহরণস্বরূপ আমাদের দৈনন্দিন তাপমাত্রার কথা ধরা যাক, দিনের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের তাপমাত্রা অনুভূত হয়।
আরো পড়ুন :
- বিসিএস পরীক্ষার্থীদের জন্য কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তি থেকে ৩০টি প্রশ্ন ও উত্তর
- তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি থেকে গুরুত্বপুর্ণ কিছু তথ্য
- ICT সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ কিছু শব্দের পূর্ণরূপ জানুন।
- প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ প্রস্তুতির জন্য তথ্য ও প্রযুক্তি
এই অনুভূত তাপমাত্রাকে যখন সংকেতরূপে প্রকাশ করি তখন তাকে এনালগ সংকেত বলি। এনালগ সংকেতের সাহায্যে আমরা নির্ভুল এবং সূক্ষ্ম তথ্য পাই না, প্রাপ্ত মানের তারতম্য থাকে। এই এনালগ সংকেতকে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে দুইটি অবস্থার মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়, এই অবস্থাগুলােকে অঙ্কের (Digit) মাধ্যমে প্রকাশ করার ফলে এনালগ সংকেতের তুলনায় আরও নির্ভুল এবং সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর তথ্য পাওয়া যায়।
Digit এর মাধ্যমে সংকেত প্রকাশের জন্য ব্যবহৃত এই ধরনের সংকেতকে ডিজিটাল সংকেত বলা হয়। যেমন: ধর, কাঁটাযুক্ত ঘড়ি এনালগ সংকেত প্রদর্শন করে, পক্ষান্তরে কাঁটাবিহীন ঘড়ি ডিজিটাল সংকেত প্রদর্শন করে। তবে ডিজিটাল বাংলাদেশ কথাটি শুধু একটি কম্পিউটার প্রস্তুত দেশ হিসেবে ব্যবহার করা হয়নি।
এটি আরও অনেক ব্যাপক। ডিজিটাল বাংলাদেশ বলতে আসলে তথ্য ও যােগাযাগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে গড়ে তােলা আধুনিক বাংলাদেশ বােঝানাে হয়। সব ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান এবং দারিদ্র্য মােচনের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন হচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশের লক্ষ্য। এই লক্ষ্যে পৌছানাের জন্যে আমাদের পুরাতন মানসিকতার পরিবর্তন করে ইতিবাচক বাস্তবতা এবং উদ্ভাবনী চিন্তা করা খুব জরুরি।
ডিজিটাল বাংলাদেশের পেছনের মূল কথাটি হচ্ছে দেশের মানুষের জন্যে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা এবং সুবিচার নিশ্চিত করা এবং সেগুলাের জন্যে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করা। তার চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে সকল শ্রেণির সব ধরনের মানুষের জীবনের মান উন্নয়ন।
ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্পের বাস্তবায়নের জন্যে সরকার চারটি সুনির্দিষ্ট বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েছে; সেগুলাে হচ্ছে- মানবসম্পদ উন্নয়ন, জনগণের সম্পৃক্ততা, সিভিল সার্ভিস এবং দৈনন্দিন জীবনে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার। পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশ তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারের কাজটি শুরু করেছে দেরিতে। তাই অন্য অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশ যথেষ্ট পিছিয়ে আছে।
অতীতে তথ্য ও যােগাযােগ প্রযুক্তির গুরুত্ব যথাযথভাবে উপলব্ধি না করলেও বর্তমানে এটি অত্যন্ত গুরুত্ব পাচ্ছে। সাবমেরিন ক্যাবলের সাথে যুক্ত হওয়ায় আমাদের দেশে এখন দ্রুত গতির ইন্টারনেট সংযােগ প্রদান সম্ভব হচ্ছে। প্রযুক্তি প্রসারের একটি সুন্দর দিক রয়েছে, কোনাে দেশ বা জাতির একটি নির্দিষ্ট প্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকলে সব সময়েই তাদের পিছিয়ে থাকতে হয় না।
বড় বড় লাফ দিয়ে (Leap Frog) অন্যদের ধরে ফেলা যায়। তাই বাংলাদেশ তার সর্বশক্তি দিয়ে সামনে এগিয়ে অন্য দেশের সমান হবার চেষ্টা করছে। সরকারের আগ্রহের কারণে দেশে তথ্যপ্রযুক্তির অবকাঠামাে গড়ে উঠতে শুরু করেছে। সারা দেশে ফাইবার অপটিক লাইন বসিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মাত্র এক-দেড় দশক আগেও এদেশে টেলিফোনের সংখ্যা ছিল নগণ্য। এখন নির্দ্বিধায় বলা যায় এই দেশের প্রত্যেকটি
প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের হাতের নাগালে ফোন রয়েছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে ইনফরমেশন সার্ভিস সেন্টার খােলা হয়েছে, প্রত্যন্ত এলাকায় পােস্ট অফিসগুলােকে ই-সেন্টারে রূপান্তরিত করে মােবাইল মানি অর্ডারের সুযােগ করে দেওয়া হয়েছে। ইউনিয়ন ইনফরমেশন সেন্টারের সাথে সাথে ডিস্ট্রিক্ট ইনফরমেশন সেল এবং ন্যাশনাল ইনফরমেশন সেল দেশের অবকাঠামােতে একটা বড় সংযােজন।
মােবাইল টেলিফোন দিয়ে ভর্তি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন, পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল জানা কিংবা ট্রেনের টিকেট কেনার মতাে কাজগুলাে নিয়মিতভাবে করা হচ্ছে। স্কুল-কলেজে তথ্য ও যােগাযােগ প্রযুক্তির পাঠ সংযােজন করা হয়েছে- এই বইটি তার প্রমাণ। দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স পড়ানাে হচ্ছে।
দেশের তরুণ প্রজন্ম বিভিন্ন সফটওয়্যার কোম্পানিতে যােগ দেওয়ার পাশাপাশি নিজেরা কোম্পানি গড়ে তুলছে এবং বিশাল সংখ্যক তরুণ-তরুণী ব্যক্তিগত পর্যায়ে আউটসাের্সিং করে দেশের অর্থনীতিকে মজবুত করছে। তথ্যপ্রযুক্তির এই সাফল্য শুনে কেউ যেন মনে না করে আমরা ইতােমধ্যে আমাদের লক্ষ্যে পৌছে গেছি- এটি মােটেও সত্যি নয়।
এই পথে আমাদের আরাে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হবে। যেহেতু আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষই গ্রামে থাকে তাই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তােলার প্রথম ধাপ হচ্ছে এই গ্রামীণ মানুষকে তথ্য ও যােগাযােগ প্রযুক্তি সেবার আওতায় নিয়ে আসা। সেজন্য এখনাে বিশাল অবকাঠামাে গড়ে তুলতে হবে।
তথ্যপ্রযুক্তির পুরাে সুবিধা পেতে হলে এক্ষেত্রে দক্ষ জনশক্তির প্রয়ােজন। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার মান বাড়াতে হবে, আরাে বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থীকে তথ্য ও যােগাযােগ প্রযুক্তিতে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। ই-গভর্ন্যান্স এর মাধ্যমে সকল কাজে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। নতুন প্রজন্মকে তাদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা কাজে লাগাতে উৎসাহী করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় এবং তথ্য ও যােগাযোেগ প্রযুক্তি শিল্পের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। তাহলেই আমরা প্রকৃত ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারব।