বরেন্দ্রভূমি বঙ্গ অববাহিকার বৃহত্তম প্লাইস্টোসিন ভূ-প্রাকৃতিক একক। প্রায় ৭,৭৭০ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে বরেন্দ্রভূমি বিস্তৃত । চতুষ্পর্শ্বের প্লাবনভূমি থেকে পৃথক এই ভূ-প্রকৃতি পুরাতন পলল গঠিত একটি ভূমিরূপ হিসেবে দীর্ঘ সময় থেকেই স্বীকৃত। বরেন্দ্রভূমির ভৌগােলিক অবস্থান মােটামুটি ২৪°২০’ উত্তর অক্ষাংশ থেকে ২৫°৩৫’ উত্তর অক্ষাংশ পর্যন্ত এবং ৮৮°20′ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ থেকে ৮৯°৩০ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত । বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি ও ইতিহাসে বরেন্দ্রভূমির গুরুত্ব অপরিসীম । বরেন্দ্রভূমি থেকে প্রাপ্ত ঐতিহাসিক বই মূল্যবান নিদর্শন দ্বারা গড়ে তােলা হয়েছে বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর । যা বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদকে অনেকগুণে সমৃদ্ধ করেছে। নিচে বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতিতে বরেন্দ্র অঞ্চল এবং বরেন্দ্র জাদুঘরের গুরুত্ব আলােচনা করা হলাে :
বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতিতে বরেন্দ্র অঞ্চলের গুরুত্ব
ভৌগােলিক গুরুত্ব :
গঙ্গা এবং ব্রহ্মপুত্রের মধ্যবর্তী অবস্থানে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের মধ্য এবং নিম্ন পশ্চিমাংশ জুড়ে এই ভূ-প্রাকৃতিক উপ-এককটি বিস্তৃত । এটি পূর্বে করতােয়া ও পশ্চিমে মহানন্দা নদীদ্বারা বেষ্টিত। পুনর্ভবা, আত্রাই ও ছােট যমুনা বরেন্দ্রভূমিকে প্রধান চারটি অংশে বিভক্ত করেছ। মহানন্দা-পুনর্ভবার মধ্যবর্তী অংশটি ব্যতীত অবশিষ্ট তিনটি অংশই বাংলাদেশের অন্তর্গত। বঙ্গীয় অববাহিকায় প্লাইস্টোসিন কালে উথিত সােপানসমূহের মধ্যে বরেন্দ্রভূমি বৃহত্তম। এর দক্ষিণাংশের অপেক্ষাকৃত পুরাতন চত্বরভাগটি সমতল মালভূমি সদৃশ এবং অন্যত্র সামান্য পরিমাণে তরঙ্গায়িত ভূপৃষ্ঠ বিশিষ্ট।
আরো পড়ুন : বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতিতে প্রবাল দ্বীপের গুরুত্ব কী?
স্থানীয় ভাষায় তরঙ্গায়িত এলাকার উঁচু অংশ ডাইং’ এবং নিচু অংশ কান্দর’ নামে পরিচিত। কার অংশের জমিগুলাে সর্বাপেক্ষা উর্বর। এই চত্বরভূমি লালচে ও হলুদাভ এবং আংশিক ছােপ ছােপ কর্দম দ্বারা গঠিত। বরেন্দ্রভূমির নিষ্কাশন প্রণালী পল্লবিত বা প্রশাখা নদীমালার উৎকৃষ্ট নিদর্শন। খাড়ি নামে পরিচিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্রোতধারাগুলাের খাত গভীর ও সর্পিল। সাধারণ প্লাবনভূমির তুলনায় অত্যধিক উঁচু (সমুদ্রপৃষ্ঠের চেয়ে প্রায় ৪৫ মি উঁচু) বলে এই ভূমি বার্ষিক প্লাবনের আওতামুক্ত থাকে।
বরেন্দ্রভূমিকে উত্তর-পূর্বে বেষ্টন করে করতােয়া নদী বরাবর ৬৪ কিলােমিটার দীর্ঘ একটি চ্যুতি বিদ্যমান। এই চ্যুতি করতােয়া নদীর গতিপথকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। অন্যান্য ক্ষুদ্র স্রোতধারাগুলাে বরেন্দ্রভূমির পূর্বাংশকে বিধৌত করে দক্ষিণ-পশ্চিমে ছােট যমুনা নদীতে পতিত হয়েছে। বরেন্দ্রভূমির দক্ষিণ-পূর্বের অবভূমিকে ভর অববাহিকা নামে আখ্যায়িত করা হয়। রাজশাহী, নাটোর ও পাবনা জেলার অংশবিশেষ নিয়ে ভর অববাহিকা গঠিত এবং এর কেন্দ্রভাগের বিশাল জলমগ্ন এলাকা চলন বিল নামে সুপরিচিত।
অর্থনৈতিক গুরুত্ব :
বঙ্গীয় অববাহিকার প্রি-ক্যাম্বিয়ান ইন্ডিয়ান প্লাটফর্মের উপর সুস্থিত হওয়ায় বরেন্দ্রভূমি খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ। খনিজ সম্পদের মধ্যে কয়লা, পিট, কঠিন শিলা, চুনাপাথর, চীনামাটি ও কাচবালি গুরুত্বপূর্ণ। বরেন্দ্রভূমির প্লাইস্টোসিন শিলা। এককের নিচে অবস্থিত প্লাটফর্ম এলাকায় মূলত এ সকল খনিজ সঞ্চয়নের উপস্থিতি রয়েছে। বগুড়া, রাজশাহী ও দিনাজপুর জেলায় উচ্চমানের বিটুমিন কয়লার সঞ্চয়ন আবিষ্কৃত হয়েছে। বরেন্দ্রভূমির প্লাইস্টোসিন পললের নিচে প্রি-ক্যাম্বিয়ান ভিত্তিস্তরে অবস্থিত গ্রস্ত উপত্যকা নামে পরিচিত ক্ষুদ্র বিচ্ছিন্ন অববাহিকায় এই কয়লা পাওয়া গিয়েছে। এই কয়লা পারমিয়ান যুগের গন্ডােয়ানা স্তরসমষ্টির অন্তর্গত এবং উৎকৃষ্টমানের।
বরেন্দ্রভূমির দক্ষিণাংশে প্লাইস্টোসিন শিলা-এককের নিচে অবস্থিত প্লাটফর্মের সােপান এলাকায় চুনাপাথর পাওয়া গিয়েছে। ইয়ােসিন যুগের এই চুনাপাথর সিমেন্ট শিল্পের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাচামাল । কঠিন শিলা বরেন্দ্র অঞ্চলের অন্য আরেকটি মূল্যবান খনিজ সম্পদ। প্রকৃতপক্ষে সমগ্র প্লাটফর্ম এলাকা প্রি-ক্যাম্বিয়ান আগ্নেয় ও রূপান্তরিত শিলা দ্বারা গঠিত। রাস্তাঘাট, সেতুসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণকাজে এই কঠিন শিলা একটি প্রয়ােজনীয় নির্মাণ উপকরণ। চীনামাটি ও কাচবালি বরেন্দ্র শিলা এককের ঠিক নিচে ভিত্তিস্তর শিলার উপরের অংশে পাওয়া যায়। সিরামিক সামগ্রী, ইলেকট্রিক সামগ্রী এবং অন্যান্য শিল্পজাত সামগ্রী তৈরিতে চীনামাটি ও কাচবালি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
সাংস্কৃতিক গুরুত্ব :
বরেন্দ্রে প্রাপ্ত প্রত্ননিদর্শন থেকে যে মৌলিক তথ্যসমূহ পাওয়া যায় তা বিশ্লেষণ করলে আদিম কালে বাংলাদেশসহ সন্নিহিত অন্য অঞ্চলগুলাের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, রাজনৈতিক ইতিহাস এবং প্রাচীন বাংলার ধর্মীয়, অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক জীবন সম্বন্ধে সুস্পষ্ট জ্ঞান লাভ করা যায়।
আরো পড়ুন : বাংলাদেশের নিষ্ক্রিয় ব-দ্বীপসমূহ বলতে কী বোঝেন?
মহাস্থান ব্রাহ্মীলিপি (বাংলায় মৌর্য শাসনের সাক্ষ্য), দামােদর পুরের গুপ্ত শাসনাবলি (বাংলায় গুপ্ত শাসনের প্রমাণ), খালিমপুর তাম্রশাসন (বাংলায় মাৎস্যন্যায় এবং তার পরবর্তী গণতান্ত্রিক বিধি বিধান প্রবর্তনের সাক্ষ্য), গরুড় ও কৈবর্ত স্তম্ভ, এছাড়া অসংখ্য বৌদ্ধ ও জৈন বিহারের ধ্বংসাবশেষ, যার মধ্যে বিশেষ করে রয়েছে জগৎ বিখ্যাত পাহাড়পুর, সীতাকোট ও ভাসুবিহার; বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের প্রতিনিধিত্বকারী অসংখ্য ভাস্কর্য; অসংখ্য প্রাচীন দুর্গনগরী যার মধ্যে রয়েছে হাজার হাজার বছর ধরে যাকে কেন্দ্র করে বাংলাসহ এতদঞ্চলের ইতিহাস আবর্তিত হয়েছে সেই পুন্ড্রনগরী বা মহাস্থানগড়; অসংখ্য প্রাচীন মন্দির, মসজিদ, জলাশয় এবং অন্যান্য উল্লেখযােগ্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন যেগুলােকে কেন্দ্র করে বাংলার ইতিহাস গঠিত বা পুনর্গঠিত হয়েছে তার সিংহভাগই বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে আহরিত হয়েছে।
বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর ও এর গুরুত্ব :
বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর রাজশাহী মহানগরের কেন্দ্রস্থল হেতেম খাঁ-তে অবস্থিত। এটি বাংলাদেশের প্রথম জাদুঘর । প্রত্নতত্ত্ব সংগ্রহের দিক থেকে এটি দক্ষিণ এশিয়ার ন্যতম সংগ্রহশালা। বরেন্দ্র জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় নাটোরের। দিঘাপাতিয়া রাজপরিবারের জমিদার শরৎকুমার রায়, আইনজীবী অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় এবং রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক রামপ্রসাদ চন্দ্রের উল্লেখযােগ্য অবদান রয়েছে।
১৯১০ খ্রিস্টাব্দে তারা বাংলার ঐতিহ্য ও নিদর্শন সংগ্রহ এবং সংরক্ষণের জন্য বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি গঠন করেন। ঐ বছরে তারা রাজশাহীর বিভিন্ন স্থানে অনুসন্ধান চালিয়ে ৩২টি দুষ্প্রাপ্য নিদর্শন সংগ্রহ করেন। এই নিদর্শনগুলাে সংরক্ষণ করার জন্য শরৎকুমার রায়ের দান করা জমিতে জাদুঘরটির নিজস্ব ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। নির্মাণ শেষ হয় ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে। একই বছরের ১৩ নভেম্বর বাংলার তৎকালীন গভর্নর কারমাইকেল জাদুঘরটি উদ্বোধন করেন । ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে জাদুঘর কর্তৃপক্ষের সাথে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে নওগাঁর পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের খনন কাজ শুরু করে। পরবর্তীতে বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতির একক প্রচেষ্টায় পাহাড়পুর থেকে ২৫৬টি নিদর্শন আবিষ্কৃত হয় ।
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের পরে জাদুঘরটির অস্তিত্ব নিয়ে সংকট দেখা দেয় । ১৯৪৯ থেকে ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জাদুঘর ভবনটির অর্ধেকাংশ মেডিক্যাল স্কুল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল । ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে জাদুঘরটি বন্ধ হবার উপক্রম হলে ঐ বছরের ১০ অক্টোবর এর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অধিগ্রহণ করে বর্তমান পর্যন্ত তারাই পরিচালনা করে আসছে। জাদুঘরটির পরিদর্শকদের মধ্যে রয়েছে মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখসহ অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ। বর্তমানে বরেন্দ্র জাদুঘরের সংগ্রহ সংখ্যা ৯ হাজারেরও অধিক। এখানে হাজার বছর আগের সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শন। রয়েছে।
মহেনজোদারাে সভ্যতা থেকে সংগৃহীত প্রত্নতত্ত্ব, পাথরের মূর্তি, খ্রিস্ট্রীয় একাদশ সংগ্রহের অন্তর্ভুক্ত। মুঘল আমলের রৌপ্য মুদ্রা, গুপ্ত সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের গােলাকার স্বর্ণমুদ্রা, সম্রাট শাহজাহানের গােলাকার রৌপ্য মুদ্রা বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। এখানে প্রায় ৫০০০ পুঁথি রয়েছে, যার মধ্যে ৩৬৪৬টি সংস্কৃত আর বাকিগুলাে বাংলায় রচিত। পাল যুগ থেকে মুসলিম যুগ পর্যন্ত সময় পরিধিতে অঙ্কিত চিত্রকর্ম ও নূরজাহানের পিতা ইমাদ উদ দৌলার অঙ্কিত চিত্র এখানে রয়েছে। জাদুঘরের সংগ্রহের মধ্যে রয়েছে পাথর ও ধাতুনির্মিত ভাস্কর্য, খােদিত লিপি, মুদ্রা, মৃৎপাত্র ও পােড়ামাটির ফলক, অস্ত্রশস্ত্র, আরবি ও ফারসি দলিলপত্র, চিত্র, বইপত্র ও সাময়িকী এবং সংস্কৃত ও বাংলা পাণ্ডুলিপিসমূহ ।